বৃহস্পতিবার, ২০ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গারা

৩০টি শিবিরে ইয়াবাসহ মাদক বিক্রির চিহ্নিত আখড়া, মিয়ানমারের ‘ইয়াবা ডন’ রোহিঙ্গারা এখন আশ্রয় শিবিরে, মানব পাচার-খুনোখুনি-অপহরণ, চাঁদাবাজি

মির্জা মেহেদী তমাল ও আয়ুবুল ইসলাম

ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গারা

গত শুক্রবারের ঘটনা। টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের। তুমুল বন্দুকযুদ্ধে তিন মাদক পাচারকারী নিহত হন। তারা হলেন- হামিদ (২২), সামশুল আলম (৩৪) ও নুরুল আলম (২৩)। পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে নিহত তিনজনই রোহিঙ্গা। তারা টেকনাফের ল্যাদা রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা ছিল বলে জানিয়েছেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস। এর কয়েক দিন আগে কক্সবাজারের টেকনাফে ৫০ হাজার ইয়াবা বড়িসহ ১৮ জনকে গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সদস্যরা। এর মধ্যে ১৩ রোহিঙ্গা নাগরিকের পেট থেকে ৪৩ হাজার ইয়াবা বড়ি জব্দ করা হয়। উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের চৌধুরীপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

চলতি মাসে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নয় হাজার ইয়াবা বড়িসহ দুই রোহিঙ্গাকে আটক করে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ। তাদের কাছে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র পাওয়া যায়। বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপস অ্যান্ড মিডিয়া) আলমগীর হোসেন এ তথ্য জানান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোয় মাদকের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। ৩০টি শিবিরে ইয়াবাসহ মাদক বিক্রির চিহ্নিত আখড়া আছে পাঁচশর বেশি। শরণার্থী শিবিরের বাইরেও রোহিঙ্গারা ইয়াবা বহন করছে। দুই দেশের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এদের নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একাংশ মাদক ব্যবসা, পরিবহন ও শিবিরের ঘরগুলোতে এসব মজুত রাখছে। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের তৈরি করা ইয়াবা ব্যবসায়ী ও চালানকারীদের যে তালিকা তাতে ১৩ জন নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা শরণার্থীরও নাম রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, ইয়াবা পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই দেশেরই কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত। আর সে কারণে এটা বন্ধ হচ্ছে না। শরণার্থী শিবিরের এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন স্থানীয় অধিবাসীরা। উখিয়ার নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে। এতে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের বাইরে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা, বাইরে থেকে শিবিরের ভিতরে যাতায়াত পর্যবেক্ষণ, ইয়াবার বিস্তার বন্ধ করার জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগ জোরদার করাসহ ২১ দফা দাবি জানানো হয়। এরপর কড়াকড়ি ব্যবস্থা নেওয়া হলেও রোহিঙ্গাদের ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবশেষ সেনা নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার আগে সেখানে রোহিঙ্গাদের অনেকেই ছিলেন ‘ইয়াবা ডন’। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসার পর কিছু দিন চুপচাপ থাকলেও দুই দেশের সেই সিন্ডিকেট ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

এ নিয়ে ক্যাম্পের কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা জানান, উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে এ চক্রের সঙ্গে জড়িত অন্তত সহস্রাধিক রোহিঙ্গা রয়েছেন। তাদের সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইন সম্প্রদায়ের যোগাযোগ রয়েছে। সূত্রটি বলছে, মিয়ানমার থেকে রাতের আঁধারে ইয়াবা ও মাদকের চালান সীমান্তের কাঁটাতারের পাশে নিয়ে আসে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। পরে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা সীমান্ত থেকে মাদকের চালান নিয়ে আসে। এভাবে প্রতিনিয়ত কোটি টাকার ইয়াবা ঢুকছে উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। পরে ইয়াবার চালান সুযোগ বুঝে চিহ্নিত সিন্ডিকেট সদস্যরা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করে। তবে সিন্ডিকেটের গডফাদাররা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুধু ইয়াবা ব্যবসাই নয়, মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধের সঙ্গেও তারা জড়িত। ক্যাম্পে নিজেরা খুনোখুনিও করে। এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে পারস্পরিক হামলা ও পরিকল্পিত খুনের ঘটনায় নিহত হয়েছে অন্তত ৩৮ জন। এ ছাড়া আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে ডজনখানেক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কক্সবাজার জেলার উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠায় স্থানীয় প্রশাসন ও বাসিন্দারা আতঙ্কিত। তাদের নানা অপরাধের কারণে শুধু কক্সবাজারই নয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দারাও আতঙ্কে রয়েছে। এদের হামলার শিকার হচ্ছেন স্থানীয় সাধারণ মানুষ থেকে পুলিশ, এনজিও কর্মকর্তা, দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও ত্রাণ সহায়তা দিতে আসা বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা। সংশ্লিষ্টরা বলছে, শুধু কক্সবাজারেই নয়, সারা দেশেই আতঙ্কের নাম এখন রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারপাশ খোলা থাকায় প্রায় প্রতিদিনই পালাচ্ছে তারা। সারা দেশে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা এভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৫৬ হাজার রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আরও প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা দেশের বিভিন্ন এলাকায় নানা পরিচয়ে আত্মগোপনে রয়েছে। তারা ইয়াবা বেচাকেনাসহ নানা অপরাধ করছে। পরিচয় গোপন করে পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশ পাড়ি দেওয়ারও চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। দিন দিন এ পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় সরকার ও প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে। উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাঁচটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গারা অবাধে অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। গহিন অরণ্যে গড়ে তুলেছে অপরাধের স্বর্গরাজ্য। মাদক ও অস্ত্র পাচারের মতো কাজে তারা জড়িত। স্থানীয় পুলিশ ও অন্যান্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বর্তমানে যে অবস্থায় রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের মধ্যে হানাহানি, সংঘর্ষ, খুন, গুম বেড়েই চলছে। রোহিঙ্গারা খুবই বেপরোয়া ও হিংস্র। বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে স্থানীয় প্রশাসন। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রাখা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল খায়ের বলেন, উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় পাঁচটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এসব ক্যাম্পে প্রায় তিন শতাধিক পুলিশ সদস্য নিয়োজিত আছেন। ক্যাম্পে অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো সামাল দিতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর