বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

মান নেই সরকারি কাজে

♦ নির্মাণ প্রকল্পে বালুর পরিবর্তে মাটি ♦ দুই দিনেই উঠে যাচ্ছে রাস্তার কার্পেটিং ♦ উদ্বোধনের আগেই সেতুতে ফাটল-ধস ♦ মেরামত ছাড়াই রং করে ঝকঝকে তকতকে

জুলকার নাইন

মান নেই সরকারি কাজে

সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অবিশ্বাস্য রকমের দুর্নীতিতে মেতেছেন ঠিকাদাররা। ৩০ কোটি টাকায় বানানো রাস্তার কার্পেটিং তোলা যাচ্ছে হাত দিয়েই। নতুন রাস্তার পিচ এমনিতেই উঠে আসছে কার্পেটের মতো। নির্মাণ শেষে উদ্বোধনের আগেই ফেটে যাচ্ছে সেতু। সেই ফাটল মেরামত না করেই পিচ ঢালাই দিয়ে ঢাকা হচ্ছে। আবার ভবন সংস্কারের নামে শুধু রং করে দেখানো হচ্ছে ঝকঝকে তকতকে। নির্মাণ প্রকল্পে বালুর পরিবর্তে সরাসরি দেওয়া হচ্ছে মাটি। মানহীন এসব কাজ করেও বিভিন্ন যোগসাজশে বিল পেতে তেমন কোনো বেগ পেতে হচ্ছে না ঠিকাদারদের। বরং চলতি মাসে অর্থবছর সমাপ্তির সুযোগে তড়িঘড়ি করে দেওয়া হচ্ছে এসব মানহীন কাজের বিলের টাকা।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের মতে, সরকারি কাজের ষোলো আনার মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বারো আনা ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে চার আনা কাজও হচ্ছে না। আবার কাজই হয়নি কিন্তু প্রকল্পের অর্থ ছাড় হয়েছে তাও এ দেশে নতুন কিছু নয়। সেসব ক্ষেত্রে তো ষোলো আনাই ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা না হওয়ার সুযোগে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে হচ্ছে দেশের বেশিরভাগ নির্মাণ প্রকল্প। মান যাচাই বা নিয়ন্ত্রণও হচ্ছে না। সবকিছুই চলছে ইচ্ছামাফিক।  জানা যায়, এক বছর আগে সংস্কার হওয়া বরগুনার বেতাগীতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনে এ বছরও সংস্কার কাজ চলছে। কারণ ভবনটির ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে, দেয়ালে দেয়ালে ফাটল, ফ্লোর নিচের দিকে দেবে গেছে ও ভাঙা প্রায় সব স্টিলের দরজা-জানালা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ের এবার নতুন করে  সংস্কারের কাজ পেয়েছে মেসার্স মাসুদ এন্টারপ্রাইজ নামক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। গত মাসের মাঝামাঝি কাজ শুরু করে এ প্রতিষ্ঠানটি। তারা কিছুই মেরামত না করে ভবনের পুরনো ময়লা, মরিচা, ফাটলের ওপর সরাসরি রং দিয়ে চকচকে-ঝকঝকে করা শুরু করে। ক্ষুব্ধ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, এ ধরনের কাজ করাতেই গত বছর সংস্কারের পরও এই ভবনের এমন জীর্ণদশা। জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি সুমন বলেন, রাজমিস্ত্রি কাজ করার পর রঙের কাজ করার কথা। কিন্তু রংমিস্ত্রি আগেভাগেই কাজ শুরু করে দেন। যে কারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বলে অজুহাত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধির।

লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার ৬ নম্বর লামচর ইউনিয়নের দাসপাড়া কুইয়ার বাড়ির সামনে ওয়াপদা খালের ওপর সেতুর  নির্মাণ কাজ শেষ না হতেই ফাটল ধরেছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ১৫ মিটার  সেতুটির নির্মাণ ব্যয় ৩২ লাখ টাকা। টেন্ডারে নির্বাচিত হয়ে গত মার্চে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জাফলং সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু করে। কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। কিন্তু বড় আকারের ফাটল ধরেছে সেতুতে। জুন ক্লোজিংয়ের অজুহাতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অর্থছাড় দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)। প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়ে গত সপ্তাহে এলাকাবাসীর তোপের মুখে পড়ে পিআইও বলেছেন, জুন ক্লোজিংয়ের পর ঠিকাদার পুনরায় কাজটি করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

একই অবস্থা কিশোরগঞ্জের তাড়াইল-নীলগঞ্জ সড়কের তালজাঙ্গা ইউনিয়নে বেতাই নদীর ওপর সেতুর ক্ষেত্রেও।  সেতুটি উদ্বোধনের আগেই দেখা যায় ফাটল। সেই ফাটলের খবর প্রকাশের পর গত সপ্তাহে এলজিইডির তাড়াইল উপজেলা প্রকৌশলীর উপস্থিতিতে তড়িঘড়ি করে ফাটলসহ পুরো সেতু পিচ ঢালাই করে দেওয়া হয়। ঢালাইয়ের দুই দিন পর বিশাল মঞ্চ বানিয়ে অনুষ্ঠান করে উদ্বোধন করা হয় বেতাই নদীর সেতু।

রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। বরিশাল সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতায় আগৈলঝাড়া উপজেলা সদরে  ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রাস্তার কার্পেটিং একদিনের মধ্যেই উঠে যায়। আগৈলঝাড়া উপজেলা সদর থেকে রাজিহার হয়ে ঘোষেরহাট পর্যন্ত বরিশাল অংশের এ নির্মাণ কাজ করে এমএম এন্টারপ্রাইজ। রাস্তা ঢালাইয়ের পরদিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সওজের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই কার্পেটিং হাত দিয়ে তুলে দেখান স্থানীয়রা। সেই ছবি প্রকাশ হয় গণমাধ্যমেও। জানা যায়, সওজের একই কার্যাদেশে একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আগৈলঝাড়া উপজেলায় বিভিন্ন সড়ক উন্নয়নে আরও প্রায় ৫৮ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নেরর কাজ করছে।

শুধু বরিশালে নয়, একই চিত্র দেখা গেছে দেশের আরও বিভিন্ন জেলায়। চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার মনপুরা গ্রামে দুই দিনের মধ্যেই কার্পেটের মতো উঠে গেছে তিন কোটি টাকার প্রকল্পের পিচ ঢালাই। সদ্য নির্মিত পাকা রাস্তা ৪৮ ঘণ্টা পরই ফাঁকা হয়ে গেছে। টাঙ্গাইলে ঢাকা-তারাকান্দি সড়কের এলেঙ্গা থেকে ভূঞাপুর পর্যন্ত  সড়ক ও জনপথ বিভাগের ১৭ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করার কাজ শেষ না হতেই ধসে পড়ছে। পার্বত্য এলাকা খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের এডিবির আওতায় ৪৩ লাখ টাকার রাস্তায় বালুর পরিবর্তে পাহাড়ের মাটি ব্যবহারের অভিযোগে বিক্ষোভ করেছে স্থানীয়রা।

বাংলাদেশের সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হাফিজউদ্দিন খান এ ব্যাপারে বলেন, সরকারি কাজের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত ঠিকাদারদের প্রায় সবাই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকছে তাদেরই সমর্থক বা সমর্থনপুষ্ট ঠিকাদাররা শুধু টেন্ডার জমা দিচ্ছেন এবং কাজ পাচ্ছেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এসব ঠিকাদার এতটাই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী যে সরকারি কর্মকর্তারাও তাদের কাজের বিষয়ে কিছু বলতে অনেক সময়ই ভয় পাচ্ছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে তারা প্রভাব খাটিয়ে কাজ শেষ হওয়ার আগেই বিল তুলে নিচ্ছেন। আর ঠিকাদার একবার বিল পেয়ে গেলে সেই কাজের বিষয়ে তেমন কিছু করার থাকে না। আবার দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ তো আছেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর