দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ। নিয়োগ বাণিজ্য, স্বেচ্ছাচারিতা, নৈতিক স্খলন, রাজনৈতিক দলাদলি, লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইন্ধন দেওয়া, ক্যাম্পাসে সময় না দেওয়াসহ আরও অনেক অভিযোগ বেশ কিছু উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এক উপাচার্যের বিরুদ্ধে রয়েছে শিশুকে বলাৎকার-চেষ্টার অভিযোগও। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বেশ কিছু উপাচার্যের বিরুদ্ধে এবার তদন্তে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি। ইতিমধ্যে দুই উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সরেজমিন তদন্ত করে এসেছে ইউজিসি প্রতিনিধি দল। ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বেশ কিছু উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এগুলো তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।’
ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, টাঙ্গাইলের সন্তোষে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলাউদ্দিন বিভিন্ন পদে নিয়োগ, আপগ্রেডেশনও দিয়েছেন খেয়ালখুশিমতো। নিয়োগের ক্ষেত্রে করেছেন আত্মীয়করণ। মাস্টাররোলে একের পর এক নিয়োগ দিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি ঈদের আগে ক্যাম্পাস বন্ধের দিনে তড়িঘড়ি করে ২৫ জনকে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে নিয়োগ দিয়েছেন। উপাচার্যের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিক্ষামন্ত্রী, ইউজিসি ও দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক বরাবর লিখিত অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অভিযোগপত্রে শিক্ষকরা বলেছেন, এই উপাচার্য আইন ও নীতিমালা ভঙ্গ করে স্বেচ্ছাচারিতায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হওয়ায় উচ্চশিক্ষা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
জানা গেছে, আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে এই উপাচার্য বিলাসবহুল বাংলো নির্মাণ করলেও তিনি সেখানে বাস করেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে মাত্র ১ হাজার টাকায় ভাড়া থাকেন তিনি। বিলাসবহুল বাংলো ফেলে তার প্রশাসনিক ভবনে থাকা নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মজাদার সব কেচ্ছা পয়দা করেছেন।
ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আহসান উল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়োগ বাণিজ্য ও নৈতিক স্খলনের। গত বছরের নভেম্বরে অভিযোগ ওঠে, কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগ পরীক্ষার আগেই ১১২ জন প্রার্থী চূড়ান্ত করেছেন এই উপাচার্য। রফিকুল ইসলাম নামের একজন চাকরিপ্রার্থী দুদকে এ-সংক্রান্ত অভিযোগ করলে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে ড. আহসান উল্লাহর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া অভিযোগ, গত বছরের নভেম্বরে চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় উপাচার্য পারিবারিক বাড়িতে ‘এ’ ব্লকের এক শিশুকে ফুসলিয়ে নিয়ে বলাৎকারের চেষ্টা করছিলেন। এ সময় কয়েকজন গিয়ে ভিসিকে ঘেরাও করে ফেলেন। এলাকাবাসী খবর পেয়ে বাসভবনই ঘেরাও করে ফেলেন। নৈতিক স্খলনের অভিযোগ তুলে এই উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা।
গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ রয়েছে নানা অভিযোগ। নীতিমালা লঙ্ঘন করে নিয়োগ দেওয়া, নিয়োগে বাণিজ্য করা, ইচ্ছামতো শিক্ষার্থী ভর্তি করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। জানা গেছে, ভিসি কোটার নামে তিনি কয়েকটি বিভাগে নিয়মবহির্ভূতভাবে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী ভর্তি করিয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ নিয়োগ বাণিজ্য, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির। একের পর এর নিয়োগ দেওয়ার সমালোচনা রয়েছে তাকে নিয়ে। অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগ বন্ধ রাখতে ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ড. ইফতেখার উদ্দিন তা মানেননি। গত ডিসেম্বরে স্থায়ী ও অস্থায়ী শতাধিক জনকে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। গত মার্চ ও এপ্রিলেও অস্থায়ী (অ্যাডহক) এবং মাস্টাররোলে ২৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন বাণিজ্য আর স্বজনপ্রীতির।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে সেই দলের শিক্ষককে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। শীর্ষ পদটিতে যদি দলীয় যোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হতো তাহলেও সমস্যা ছিল না। কিন্তু দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বেশির ভাগ উপাচার্যই অযোগ্য। তারা তদবির, তেলবাজি, তাঁবেদারি করে উপাচার্য হয়েছেন। যোগ্যরা তদবির, তেলবাজি, তাঁবেদারি পছন্দ করেন না।’ এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, ‘উপাচার্য পদে যোগ্যদের নিয়োগ দিতে হবে। অযোগ্যরা এ পদে এলে তারা অযোগ্যদের শিক্ষক পদে নিয়োগ দেবেন। এর ফলে শিক্ষার পরিবেশও থাকবে না, মানও থাকবে না।’