মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

চলে গেলেন সাদেক হোসেন খোকা

বৃহস্পতিবার আসছে মরদেহ

নিজস্ব প্রতিবেদক

চলে গেলেন সাদেক হোসেন খোকা

বীর মুক্তিযোদ্ধা, অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা (৬৭) আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে বাংলাদেশ সময় বেলা ১টা ৫০ মিনিটে একটি ক্যান্সার হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। এ সময় তার স্ত্রী, দুই পুত্র, কন্যা, জামাতাসহ স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, যথাযথ প্রক্রিয়ায় খোকার মরদেহ দেশে এনে রাজধানীর জুরাইনে তার বাবার কবরের পাশে তাকে চির শায়িত করা হবে। সাদেক হোসেন খোকার মরদেহ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এমিরেটাস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকা এসে পৌঁছবে বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে। একই ফ্লাইটে তার স্ত্রী সন্তানসহ পরিবারের অন্যরাও ঢাকায় আসবেন। নিউইয়র্ক সময় বাদ এশা জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে খোকার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তার বড় ছেলে ইশরাক হোসেন এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘রবিবার রাত ২টা ৫০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় সোমবার দুপুর ১টা ৫০ মিনিট) বাবার মৃত্যু হয়। দেশবাসীর কাছে বাবার জন্য দোয়া চাই। আমরা বাবাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এ ব্যাপারে নিউইয়র্ক কনস্যুলেট অফিসে যোগাযোগ করা হচ্ছে। পরিবারের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’ সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুর খবর শোনার পর কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়া শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন বলে কারাসূত্র জানিয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। তারা শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। গভীর শোক প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুতে তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাই। তারা যদি সাদেক হোসেন খোকার মরদেহ দেশে আনতে চায় তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। এক্ষেত্রে যদি কোনো সহযোগিতা প্রয়োজন হয় তা আমরা করব।

বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইং সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুর খবর শুনে তার গোপীবাগের বাসায় নেতা-কর্মীরা ভিড় জমান। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার, জাতীয় পার্টির সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপিসহ সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে সেখানে। এ সময় খোকার ভাই আনোয়ার হোসেনকে জড়িয়ে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। সাদেক হোসেন খোকার লাশ দেশে আনতে সরকার ‘সর্বাত্মক’ সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘তিনি (সাদেক হোসেন খোকা) তো ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, এ জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গতকালই বলা হয়েছিল, তাকে আনার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হচ্ছে ও হবে।’ ক্যান্সারে আক্রান্ত খোকা গত পাঁচ বছর ধরেই নিউইয়র্কে অবস্থান করছিলেন। গত ১৮ অক্টোবর থেকে তিনি ভর্তি ছিলেন ম্যানহাটনের মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারে। এ অবস্থায় গত মাসের শেষার্ধে খোকার মুখে ঘা হলে খাবার গ্রহণ করতে সমস্যা হচ্ছিল। সে জন্যে তাকে হাসপাতালে ভর্তির পর ২৭ অক্টোবর তাঁর শ্বাসনালিতে অস্ত্রোপচার করে টিউমার অপসারণ করা হয়। এরপরই শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। চিকিৎসকরাও হাল ছেড়ে দেন। গত পাঁচ দিন তাকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। সাদেক হোসেন খোকার বিশেষ সহকারী সিদ্দিকুর রহমান মান্না জানান, স্যারের (সাদেক হোসেন খোকা) শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর লাশ বাংলাদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। এ ব্যাপারে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনস্যাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুননেসা জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা খোকার লাশ বাংলাদেশে পরিবহনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। লাশের সঙ্গে তার স্ত্রীকেও ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে দুর্নীতির এক মামলায় সাদেক হোসেন খোকার ১০ বছর সাজা হয়। বিদেশে থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালে তার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি আর পাসপোর্ট পাননি বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খোকা দেশে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করে গিয়েছিলেন বলে বিএনপি নেতারা জানান।

খোকার মৃত্যুতে যত শোক : সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। এ ছাড়া শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন,

বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও ব্রাদার্স ইউনিয়ন লিমিটেড।

এ ছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.), মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, কৃষক দলসহ সব অঙ্গসংগঠন শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। ২০-দলীয় জোটের পক্ষ থেকে জামায়াত, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, এলডিপি, কল্যাণ পার্টি, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) জাগপা, খেলাফত মজলিশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন গভীর শোক প্রকাশ করে।

গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা থেকে জননেতা : বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা হয়েছিলেন সাদেক হোসেন। এরপর দীর্ঘ পথ চলায় তৃণমূল থেকে রাজনীতি করতে করতে উঠে এসেছেন জননেতা হয়ে। হয়েছেন জনপ্রতিনিধি, হয়েছেন মন্ত্রী, অবিভক্ত ঢাকার নগর পিতাও ছিলেন তিনি টানা ১০ বছর। জন্ম ১৯৫২ সালের ১২ মে মুন্সীগঞ্জে সৈয়দপুরে। বাবা-মায়ের সঙ্গে শিশুকাল থেকেই বসবাস পুরান ঢাকার গোপীবাগে। বাবা এম এ করীম প্রকৌশলী ছিলেন। শিশুকাল থেকেই বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সাদেক হোসেন খোকার জীবন। একাত্তরের স্বাধীনতার উত্তাল সংগ্রামের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে মা-বাবাকে না জানিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যান বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে। একাত্তরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। দুর্ধর্ষ গেরিলা ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। ডিএফপি ছাড়াও রাজারবাগের কাছে মোমিনবাগে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের প্রধান কার্যালয়, ঢাকা হলের পেছনে এয়ারফোর্সের রিক্রুটিং সেন্টার খোকার নেতৃত্বে বিস্ফোরণ ঘটানো হয় সফলভাবে।

ছাত্র জীবনে রাজনীতির শুরুটা বাম রাজনীতি দিয়ে। ইউনাইটেড পিপলস লীগ (ইউপিপি-কাজী জাফর) এবং পরে ন্যাপ ভাসানীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে যখন দলের হাল ধরেন খালেদা জিয়া সেই সময়ে ১৯৮৪ সালে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতির যাত্রা শুরু করেন তিনি। তৃণমূল পর্যায় থেকে নেতৃত্ব পেয়ে দলের ভাইস চেয়ারম্যান পদে দায়িত্বে ছিলেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। প্রথম গোপীবাপ-কোতোয়ালির ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তিনি জনপ্রতিনিধি হন। এরপর ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল। টানা ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ১০ বছর তিনি ঢাকার মেয়র ছিলেন যা অতীতে কারও রেকর্ড নেই। ঢাকা সিটি মেয়র হিসেবেই সাদেক হোসেন খোকা দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বরণ্যে শিল্পী-সাহিত্যিকদের নামে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করেন। বিএনপির ঢাকা মহানগরের সভাপতির পাশাপাশি সাদেক হোসেন খোকা দলের নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রভাগে ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। যখনই কোথাও মানুষের বিপদ হয়েছে, যখনই কোনো নেতা-কর্মী সংকটে পড়েছেন, সেটা সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক বা ক্রীড়াঙ্গনে হোক ছুটে গেছেন সাদেক হোসেন খোকা। বিএনপির পাশাপাশি দলটির অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতিও ছিলেন খোকা। খালেদা জিয়ার দুই সরকারের মন্ত্রী ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েই ১৯৯১ যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং ২০০১ সালে মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়নের দায়িত্ব নেন সাদেক হোসেন খোকা। তিন বছরে ঘরোয়া ফুটবলের তৃতীয় ডিভিশন থেকে প্রথম ডিভিশনে উঠে ব্রাদার্স ইউনিয়ন। এ ছাড়া ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ফরাশগঞ্জ ক্লাব এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।

সর্বশেষ খবর