রবিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ত্রিমুখী হামলা চালিয়ে শত্রুমুক্ত করেছিলাম কুষ্টিয়া জেলা

লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী

ত্রিমুখী হামলা চালিয়ে শত্রুমুক্ত করেছিলাম কুষ্টিয়া জেলা

একাত্তরের মার্চে আমি আমার বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার পরদিন একজন ক্যাপ্টেন ও তিনজন সৈনিক আমার বাহিনীর হাতে নিহত হয়। ৩০ মার্চ কুষ্টিয়া আক্রমণ করি। আমাদের ত্রিমুখী হামলায় দিশাহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের দুই শতাধিক সেনার একটি দলকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে আমরা কুষ্টিয়া জেলাকে শত্রুমুক্ত করেছিলাম।

আমার সৈনিক জীবন শুরু ১৯৫৮ সালে। ওই বছর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পেয়ে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগদান করি। ১৯৬৮ সালে মেজর পদে উন্নীত হই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় আমি লাহোর ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে আমরা বাঙালিদের বিরুদ্ধে অনেক কথা শুনেছি। বুঝতে পারছিলাম পাকিস্তানিরা নির্বাচনে বিজয়ী বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। সে সময় সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের ওপর অন্যায়-অত্যাচার দেখে হতাশ হয়ে পড়ি। নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি দেখে বুঝতে কষ্ট হয়নি যে অচিরেই বাংলার ওপর নেমে আসবে বিরাট আঘাত। তখন আমি আবেদন করি বাংলাদেশে পোস্টিং দেওয়ার জন্য। আমাকে ডেপুটেশনে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) পাঠিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পৌঁছি, ১০ দিন পর ইপিআরে যোগদান করি। আমাকে চুয়াডাঙ্গায় ৪ নম্বর উইংয়ে কমান্ডার হিসেবে পাঠানো হয়। আমি ছিলাম ইপিআরের প্রথম বাঙালি কমান্ডার। ২৫ মার্চ ছিল আমাদের বিবাহের রাত। একটা কাজে আমি পরিবারসহ কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে। ঢাকায় বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের ঝাঁপিয়ে পড়ার খবর জানি না। ২৬ মার্চ ভোরে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ রোডে দেখলাম আর্মির অনেক গাড়ি। তারা ৩০ ঘণ্টা কারফিউ জারি করেছে। রাস্তা বন্ধ। কোথাও যোগাযোগ করতে পারলাম না। আমি ক্ষেত-খামার দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ঝিনাইদহ হয়ে চুয়াডাঙ্গায় উইং সদরে পৌঁছাতেই উইং হাবিলদার মেজর মুজিবুর রহমান দৌড়ে এসে জানালেন, আমাকে নিয়ে যেতে যশোর থেকে পাকিস্তানি এক মেজর এসেছিলেন। নাম সরদার আবদুল কাদের। সর্বত্র খুঁজে না পেয়ে ২৬ তারিখ ভোর ৫টায় ফিরে গেছেন। এদিকে দেখলাম আমার বাহিনী অবাঙালি সেনাদেরও নিরস্ত্র করে গৃহবন্দী করে রেখেছে। বুঝতে পারছিলাম তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু শত্রুদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, আমাদের শুধু থ্রি নট থ্রি রাইফেল। তখন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটির রেকর্ড শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুনলাম। দেখলাম ভাষণেই সব রকম নির্দেশ আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম, বিদ্রোহ আমাকে করতেই হবে। জরুরি ভিত্তিতে স্থানীয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নেতা, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, ছাত্রনেতা, পুলিশ, আনসার ও বেসামরিক বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের খবর দিই। তাদের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করি। বাইরে এসে দেখি হাজারো মানুষ। ঘোষণা দিলাম তোমাদের নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করব। এরপর সেখানে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে নতুন দেশের নতুন পতাকা উঠিয়ে গার্ডদের নিয়ে গার্ড অব অনার দিলাম। ২৬ মার্চ আমি বিদ্রোহ ঘোষণা করি। ২৭ মার্চ যশোর থেকে আগত একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন ও তিনজন সৈনিক আমার বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়। এরপর প্রথমে কুষ্টিয়া, পরে যশোর সেনানিবাস আক্রমণের পরিকল্পনা করি। ৩০ মার্চ স্থানীয় জনগণের সহায়তা নিয়ে কুষ্টিয়া আক্রমণ করলাম। তিন দিক থেকে আক্রমণে দিশাহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের চারজন অফিসারের তিনজন নিহত ও একজন ধরা পড়ে। বাকিরা আমাদের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়। ১৭ এপ্রিল আমার নিয়ন্ত্রণাধীন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে বিশ্বের ৩৯টি দেশের শতাধিক সাংবাদিকের উপস্থিতিতে নবগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। ওই অনুষ্ঠানে আমার এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যদের গার্ড অব অনার দিয়েছিলাম। ২৭ মে ভোর ৪টায় পাকিস্তানিরা দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে ভোমরায় অবস্থানরত আমার বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। শুরু হয় তীব্র যুদ্ধ। যুদ্ধ চলে ১৭ ঘণ্টা। আমরা তাদের প্রতিহত করতে সক্ষম হই। ওই যুদ্ধে পাকিস্তানের অফিসারসহ প্রায় ৩০০ সেনা হতাহত হয়। এক হিসাবে  দেখা গেছে, এই সেক্টরে প্রতি মাসে গড়ে ৭০০ শত্রুসেনা নিধন হয়েছে। ১১ আগস্ট আমাকে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। স্থলাভিষিক্ত হন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর এম এ মঞ্জুর। আমাকে মুক্তিবাহিনীর সদর দফতর মুজিবনগরে অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ অব স্টাফ (লজিস্টিকস)-এর দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন আমি কলকাতা চলে গেলাম। ১৬ ডিসেম্বর দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় আমি কলকাতায় অবস্থান করায় সেই আনন্দঘন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারিনি।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধে ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার। অনুলেখক : শামীম আহমেদ

সর্বশেষ খবর