শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
আইসিজেতে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আদেশের অপেক্ষা

মিয়ানমারের বক্তব্যকে ফ্রড বলল গাম্বিয়া, অভিযুক্ত সেনাবাহিনীকে বিচারের ভার দেওয়া যায় না, গণহত্যা বন্ধের আহ্বান, সু চির নিন্দায় ১০ সিনেটর

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আদেশের অপেক্ষা

আদালতে বক্তব্য দেন গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অব্যাহত রয়েছে বিক্ষোভ -এএফপি

জাতিসংঘের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) যুক্তি খ-ন শেষ করেছে গাম্বিয়া ও মিয়ানমার। নেদারল্যান্ডসের হেগে তিন দিনের শুনানির শেষ দিনে গতকাল গণহত্যা বন্ধ, আলামত সংগ্রহ, তদন্ত ও নিরাপত্তাসহ অন্তর্বর্তীকালীন ছয় আদেশ চেয়েছে গাম্বিয়া। শেষ দিনের যুক্তি খ-নে মিয়ানমারের আইনজীবীর দ্বিচারিতার কথা তুলে ধরেছে গাম্বিয়া। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের বক্তব্যকেও প্রতারণামূলক বলে আদালতকে জানিয়েছে। আশা করা হচ্ছে আগামী চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে আদালত থেকে আসতে পারে পূর্ণাঙ্গ আদেশ। তবে এর আগে মিয়ানমার যেন গণহত্যার আন্তর্জাতিক তদন্তের জন্য আলামত নষ্ট না করতে পারে সেজন্য নিশ্চয়তা চাওয়া হয়েছে গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকা মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চি আদালতে দাবি করেন, ‘সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কাজ করছে। আদালতের কাছে আমরা এ সুযোগ চাই।’ শেষে দ্রুততম সময়ে রায় ঘোষণার অঙ্গীকার করে শুনানি সমাপ্তির ঘোষণা দিয়ে এজলাস ত্যাগ করেন ১৫ স্থায়ী বিচারক ও দুই অ্যাডহক বিচারক। এখন সেই রায়ের অপেক্ষা করছে বিশ্ব।

গতকাল বিকাল ৩টায় শেষ দিনের শুনানিতে যুক্তি খ ন শুরু করে গাম্বিয়া। শুরুতেই গাম্বিয়ার পক্ষে আইনজীবী পল রাইখলার বলেন, ‘মিয়ানমারের আইনজীবী অধ্যাপক সিবার্স গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণের জন্য সাতটি নির্দেশকের কথা বলেছেন। সেই নির্দেশকগুলোর কথা গাম্বিয়ার আবেদনে রয়েছে এবং মিয়ানমার সেগুলো অস্বীকার করেনি। এ ছাড়া আদালত নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, সু চি আদালতে রোহিঙ্গা বিশেষণটি ব্যবহার করেননি। শুধু বিচ্ছিন্নতাবাদী আরসা গোষ্ঠীর কথা বলার সময় ছাড়া তিনি তাদের মুসলিম হিসেবে বর্ণনা করেছেন।’ উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের বক্তব্যকে প্রতারণা অভিহিত করে রাইখলার বলেন, ‘মিয়ানমার নিজেই স্বীকার করেছে যে, খুব সামান্য সংখ্যাই ফিরেছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের আইনজীবী মিস ওকোয়া প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ এবং চীন, জাপান ও ভারতের সহায়তার বিষয়টিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এঁরা প্রত্যাবাসন চান, কিন্তু প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব মিয়ানমারের। মিয়ানমার তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।’

এরপর গাম্বিয়ার পক্ষে আইনজীবী পিয়েঁর দ্য আর্জেন বক্তব্য দিতে উঠে বলেন, ‘গাম্বিয়া স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এ মামলা করেছে। গাম্বিয়া ওআইসির কথায় মামলা করেনি। এ ছাড়া গাম্বিয়া ওআইসির সাহায্য চাইতেই পারে। অন্যদেরও সাহায্য চাইতে পারে। সুতরাং গাম্বিয়া ওআইসির সহায়তা নেওয়ায় বলা যাবে না যে, ওআইসি এ মামলার আবেদনকারী।’ তিনি বলেন, ‘গাম্বিয়া ওআইসি মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর মামলা করেছে বলে মিয়ানমারের আইনজীবী স্টকারের দাবি বিভ্রান্তিকর। মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ ওআইসির নয়, গাম্বিয়ার। গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘে গণহত্যার কথা বলেননি বলে যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে, ওআইসির সিদ্ধান্তের পরই গাম্বিয়া মামলা করেছে- কথাটি ঠিক নয়। গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘে বক্তব্য দেওয়ার পর জাতিসংঘ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই রিপোর্টের তথ্যের ভিত্তিতেই গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে গাম্বিয়া আদালতে আসার সিদ্ধান্ত নেয়।’ তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের আইনজীবী স্টকার বলেছেন, কোনো অপরাধ যদি ঘটেও থাকে, তাহলে গাম্বিয়ার সেই বিষয়ে মামলা করার অধিকার নেই। মামলা কূটনৈতিক ব্যবস্থায় তার আপত্তির কথা জানাতে পারে, কিন্তু আদালতে আসতে পারে না। স্টকারের এসব বক্তব্য সঠিক নয়। গাম্বিয়া সনদের স্বাক্ষরকারী হিসেবে সনদ লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদনের অধিকার রাখে।’ এরপর দাঁড়িয়ে প্রফেসর ফিলিপ স্যান্ডস গাম্বিয়ার পক্ষে বলেন, ‘১৯৪৮ সালের গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণ করছে কিনা, সে প্রশ্ন তোলার অধিকার গাম্বিয়ার অবশ্যই রয়েছে।’ এ বিষয়ে তিনি অতীতের রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সনদের অংশীদার হিসেবে অন্তর্বর্তী আদেশের আবেদন করার অধিকার গাম্বিয়ার রয়েছে।’ ফিলিপ স্যান্ডস বলেন, ‘গণহত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিয়ানমারের আইনজীবী সিবার্স একটি নতুন আইনগত মান নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন, যা পরীক্ষিত নয়। কিছু কিছু কার্যক্রম গণহত্যার নির্দেশিকার ধারণা তৈরি করলেও সব কার্যক্রম গণহত্যার ধারণা প্রমাণ করে না- এমন দাবি ঠিক নয়।’ অধ্যাপক সিবার্স শিক্ষাবিদ হিসেবে ২০১৩ সালে গণহত্যা কাকে বলে, তার ব্যাখ্যায় আলজাজিরাকে কী বলেছিলেন, তা উল্লেখ করে স্যান্ডস বলেন, ‘তিনি যে মত বদলাতে পারেন না, সে কথা আমি বলব না।’ প্রফেসর স্যান্ডস বলেন, ‘অন্তর্বর্তী আদেশ পরিস্থিতির জন্য সহায়ক হবে না, মিয়ানমারের এমন দাবির জবাব হচ্ছে, আমরা এ কারণেই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছি। বসনিয়ায় আদেশ দেওয়ার পরও সেব্রেনিৎসায় যে গণহত্যা হয়েছিল, সেই দৃষ্টান্ত দিয়েই আমরা বলেছি, সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা কেন প্রয়োজন এবং তার বাস্তবায়নের সময় বেঁধে দেওয়া জরুরি। সিবার্স তার ২০১৩ সালের সাক্ষাৎকারে গণহত্যা প্রতিরোধে যেসব পদক্ষেপ প্রয়োজন বলেছিলেন, সেগুলো যদি আদালত তার নির্দেশে অন্তর্ভুক্ত করেন, তাতে আমরা আপত্তি করব না।’ গাম্বিয়ার পক্ষে সবশেষে দেশটির আইনমন্ত্রী আবুবকর তামবাদু বলেন, ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জীবন হুমকির মুখে। গাম্বিয়া প্রতিবেশী না হতে পারে, কিন্তু গণহত্যা সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে গণহত্যা বন্ধ এবং তা প্রতিরোধে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে গাম্বিয়া ওআইসির কাছে সাহায্য চেয়েছে। সার্বভৌম দেশ হিসেবে গাম্বিয়া একা এই আবেদন করেছে। গাম্বিয়া গণহত্যা সনদের রক্ষক হিসেবে এই আদালতের কাছে জরুরি ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার নির্দেশনার দাবি জানাচ্ছে।’ তামবাদু ছয়টি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার দিকনির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তার বক্তব্য শেষ করেন। এর মাধ্যমে গাম্বিয়ার বক্তব্য উপস্থাপন শেষ হয়েছে। গাম্বিয়া মিয়ানমারের যেসব যুক্তি খ-ন করেছে মিয়ানমার সেগুলোর প্রত্যুত্তর দেওয়া এবং নিজেদের দাবির পক্ষে সমাপনী বক্তব্য শুরু করে বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায়। শুরুতেই মিয়ানমারের নিযুক্ত আইনজীবী ক্রিস্টোফার স্টকার আগের দিনের মতো বলেন, ‘মামলার জন্য গাম্বিয়াকে কে বা কারা অর্থায়ন করছে দেশটির আইনজীবীরা তা বলেননি। ফলে গাম্বিয়াকে কারা অর্থ দিয়েছে তা স্পষ্ট নয়। গাম্বিয়া নিজের অর্থে মামলা করছে কিনা তা স্পষ্ট নয়।’

এদিকে মার্কিন সিনেটে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট দশ সদস্য মিয়ানমার সেনাদের পক্ষ নেওয়ায় সু চির নিন্দা করেছেন। এক চিঠিতে তারা এ নিন্দা জানান।  ওআইসির নথি উদ্ধৃত করে স্টকার বলেন, ‘ওআইসির সিদ্ধান্তেই এ মামলা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ওআইসির তরফে মামলা করা হয়ে থাকলে তা চলতে পারে না বলে আমাদের যে দাবি গাম্বিয়া তার কোনো জবাব না দেওয়ায় ধরে নেওয়া যায় দেশটি তা অস্বীকার করছে না। ওআইসির এ ধরনের মামলার অধিকার নেই। ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই সনদের বাধ্যবাধকতার কথা বলতে পারত বলে আমরা আগেই প্রশ্ন তুলেছি। কিন্তু গাম্বিয়া এ ক্ষেত্রে গণহত্যা সনদের দায়িত্ব পালনের দাবি জানানোর অধিকার রাখে না। গণহত্যা সনদের ৯ ধারায় বাংলাদেশ আপত্তি জানানোর কারণে গণহত্যার অভিযোগে মামলা করতে না পারলেও অন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের।’

এরপর বক্তব্য দিতে উঠেছেন মিয়ানমারের নিযুক্ত আরেক আইনজীবী অধ্যাপক সিবার্স বলেন, ‘গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণের জন্য ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর কথা বলা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ফেসবুকের একটি বক্তব্যকে উদ্ধৃত করা হয়েছে যাতে দীর্ঘদিনের অসম্পন্ন বাঙালি সমস্যা সমাধানের কথা বলা হয়েছে। এটিকেই সবচেয়ে বড় প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। অথচ ওই বক্তব্যে ক্লিয়ারিং অপারেশনের কোনো উল্লেখ ছিল না। বরং সমস্যাটি সমাধানে সরকারের উদ্যোগের প্রতিফলন ঘটেছে। এটি বিদ্বেষমূলক বক্তব্য নয়। আর ২০১৭-এর ঘটনাবলির পরও লাখ লাখ রোহিঙ্গা এখনো মিয়ানমারে রয়েছেন।’ তাদের গোষ্ঠীগতভাবে ধ্বংসসাধনের চেষ্টা হয়নি দাবি করেন অধ্যাপক সিবার্স।

সবশেষে যুক্তি খ ন করতে উঠে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি দাবি করেন, ‘ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্রের মতো মিয়ানমারেও সামরিক অপরাধের বিচার সামরিক বিচারব্যবস্থায়ই হয়। এ ধরনের বিচার করতে মিয়ানমারে এখনো সামরিক আদালতে বিচার চলছে। ওই বিচারকে বাধাগ্রস্ত করা ঠিক হবে না।’ সাফাই গাওয়ার অংশ হিসেবে মংডু শহরে একটি ফুটবল ম্যাচে হাজির দর্শকদের ছবি দেখিয়ে সু চি বলেন, ‘সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কাজ করছে এবং আমরা তা চালিয়ে যেতে চাই। আদালতের কাছে আমরা সেই সুযোগ চাই।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর