রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নতুন রুটে অস্ত্র পাচার

মির্জা মেহেদী তমাল

নতুন রুটে অস্ত্র পাচার

সিলেটের গোয়াইনঘাটের বিছানাকান্দি সীমান্ত। ওপারেই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ‘লাকাট হাট’। সপ্তাহে তিন দিন সেই হাট বসে। ওই হাটকে কেন্দ্র করে সীমান্তের এপারেও জমে ওঠে হাট-বাজার। যাকে সীমান্ত হাট বলা হয়ে থাকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার সুযোগ দিতে কিছু সময়ের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়। এ সময় দুই দেশের মানুষ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে দুই দেশে অবাধ যাতায়াত করতে পারে।

বিছানাকান্দির সীমান্ত গ্রাম নোয়াগাঁওয়ের কৃষক আরব আলীও এই সীমান্ত হাটে নিয়মিত যান। ভারতীয় পণ্য কারবারিদের সঙ্গে তার পরিচয়। একসময় পরিচয় হয় ভারতীয় অস্ত্র কারবারিদের সঙ্গে। অস্ত্র পাচারে অনেক টাকা-এমন ধারণা তার মাথায় ঢুকে গেলে কৃষিকাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ে। জড়িয়ে পড়েন অস্ত্র পাচারে। ভারতীয় কারবারিদের কাছ থেকে অস্ত্রের চালান নিয়ে নিজ বাড়িতে রাখেন। বাড়িতে বসেই অস্ত্র বেচাকেনা করেন। অল্পদিনেই আরব আলী কৃষক থেকে হয়ে ওঠেন অস্ত্র কারবারি। তার এই অস্ত্র আরও দুবার হাতবদল হয়ে পৌঁছে যায় দেশের অপরাধীদের কাছে। দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে চালু করা সীমান্ত হাট হয়ে ওঠে অস্ত্র পাচারের নিরাপদ রুট।

যশোর বেনাপোলের সীমান্ত গ্রাম পুটখালী। ওপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনার সীমান্ত গ্রাম আংরাইল। এই দুই গ্রামের মাঝে দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতী নদী। ওপারের অস্ত্র কারবারিরা গোসল করতে নেমে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে অস্ত্রের চালান ভাসিয়ে দেয়। ভাসতে ভাসতে সেই অস্ত্রের চালান প্রবেশ করে বাংলাদেশের নদীর অংশে। এপারের ব্যবসায়ীরা একই ভাবে গোসল করতে নেমে সেই চালান নদী থেকে তুলে নেয়। সেই অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

অস্ত্রের চালানসহ গ্রেফতার হওয়া ব্যবসায়ীদের জেরা ও পুলিশের ব্যাপক অনুসন্ধানে নতুন রুটের এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সিলেটের বিছানাকন্দি সীমান্ত হাট বা ইছামতী নদী শুধু নয়, অস্ত্র কারবারিরা নতুন রুট তৈরি করে নিরাপদেই এভাবে অস্ত্র নিয়ে আসছে। আর এসব অস্ত্র সারা দেশের অপরাধীদের কাছে ছড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের চিহ্নিত ১০টি পয়েন্ট দিয়ে অস্ত্র পাচার হয়ে আসছে। নজরদারির কারণে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা তাদের রুট পাল্টে বিভিন্ন কৌশলে অস্ত্র নিয়ে আসছে। জানা গেছে, গত ৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সায়েদাবাদে তিন অস্ত্র চোরাকারবারিকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে গুলিসহ একটি ০.২২ বোর ১২ চেম্বার রিভলভার এবং দুটি ০.৩২ বোর ছয় চেম্বার রিভলভার উদ্ধার হয়। এর কদিন আগে রাজধানীর মিরপুরে টেকনিক্যাল মোড়ে অস্ত্র ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমানকে ম্যাগাজিনযুক্ত নাইন এমএম একটি পিস্তল, দুটি ওয়ানশুটার এবং একটি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১৭ রাউন্ড গুলিসহ  গ্রেফতার করা হয়। এর আগে গত ১ জুলাই রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকা থেকে সিটিটিসি ইউনিট কামাল হোসেন এবং সাইদুল ইসলাম মজুমদার ওরফে রুবেল নামের দুজন অস্ত্র চোরাচালানিকে একটি একে-২২ রাইফেলসহ গ্রেফতার করে। ১৯ জুলাই রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় চারটি বিদেশি পিস্তল, দুটি বিদেশি রিভলবার, সাতটি ম্যাগাজিন ও ১২৮টি গুলিসহ গ্রেফতার করা হয় শীর্ষ মাদক কারবারি মিনহাজুল ইসলাম মিমসহ তিনজনকে। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে খিলগাঁও এলাকার একটি বাসা থেকে একে-২২ রাইফেল, চারটি বিদেশি পিস্তল, একটি বিদেশি রিভলবার ও বিভিন্ন অস্ত্রের ৪৭টি গুলিসহ গ্রেফতার করা হয় খান মোহাম্মদ ফয়সাল, জিয়াউল আবেদীন ওরফে জুয়েল ও জাহিদ আল আবেদিন ওরফে রুবেলকে। অল্প সময়ের ব্যবধানে বেশ কয়েকটি অস্ত্র চালান আটকের পর পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ভাবীয়ে তোলে। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের জেরা ও ব্যাপক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে অস্ত্র পাচারের অজানা তথ্য। কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার দল সূত্রে জানা যায়, সাধারণত ১২-চেম্বারের শটগান হয়। কিন্তু ১২ চেম্বারের রিভলবার হতে পারে, উদ্ধারের আগ পর্যন্ত তা গোয়েন্দাদের ধারণাই ছিল না। ১২ চেম্বারের রিভলবার বাংলাদেশে এই প্রথম উদ্ধার করা হয়েছে বলে বাহিনীটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। সূত্র জানায়, মেঘালয়ের লাকাট হাট ছাড়াও সিলেট সীমান্তঘেঁষা মেঘালয় ও আসামে রয়েছে এ ধরনের আরও অন্তত পাঁচটি সীমান্ত হাট, যেখান দিয়ে মাঝে মধ্যেই অবৈধ অস্ত্রের চালান নিয়ে আসছে চোরাকারবারিরা। সিটিটিসির তদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সায়েদাবাদ থেকে গ্রেফতারকৃত ১২ চেম্বারের রিভলবারসহ গ্রেফতার কৃত শহীদ জানিয়েছে, তিনি (শহীদ) গত দুই বছরে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ২৪৪টি অবৈধ অস্ত্র কিনেছে। বিছানাকান্দির কৃষক আরব আলীর কাছ থেকেই তার এই অস্ত্রের চালান এসেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছে, ভারতীয় ব্যবসায়ী খাইস্যার কাছ থেকে আরব আলী নিয়ম করে অবৈধ অস্ত্রের চালান সীমান্ত হাট থেকে নিয়ে আসে। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে, আরব আলীর কাছ থেকে প্রতিটি রিভলবার ২০-২৫ হাজার টাকায় কেনেন আনছার ও শহীদ। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দোলন ও আমিনের কাছে প্রতিটি বিক্রি করেন ৪০-৫০ হাজার টাকায়। তারা পেশাদার সন্ত্রাসীদের কাছে প্রতিটি অস্ত্র ৬৫-৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। এ ঘটনাটি তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোরের বেনাপোল, কুষ্টিয়া, হিলি, আখাউড়া, ঠাকুরগাঁও ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাসহ মোটা দাগে ১০টি পয়েন্ট দিয়ে অস্ত্র পাচার হয়ে আসত। পুলিশের তালিকাভুক্ত অস্ত্র ব্যবসায়ী এরাই দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অস্ত্র আনছে। ইতিমধ্যে পাচার হয়ে আসা বেশ কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্র উদ্ধারও হয়েছে। উদ্ধার হওয়া ছোট অবৈধ অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে উগনি কোম্পানির রিভলবার, মাউজার পিস্তল, ইউএস তাউরাস পিস্তল, ইতালির প্রেটো বেরোটা পিস্তল, জার্মানির রুবি পিস্তল, ইউএস রিভলবার, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি নাইন এমএম পিস্তল ও মেঘনাম কোম্পানির থ্রি টু বোরের রিভলবার। স্প্যানিশ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রও পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, চীন, ইসরায়েল, জার্মানি ও রাশিয়ার তৈরি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা এবং ভারত ও মিয়ানমার থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে দেশে ঢুকছে। চাইনিজ রাইফেল, পিস্তল, রিভলবার, স্টেনগান, মেশিনগান, সাব-মেশিনগান, কালাশনিকভ সিরিজের একে-৪৬, একে-৪৭, একে-৫৪, একে-৫৬, একে-৭৪ ও এম-১৬-এর মতো ভয়ঙ্কর অস্ত্রও আসছে। তবে এবারই প্রথম গোয়েন্দারা জানতে পারেন, সিলেটের গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি সীমান্ত হয়ে একটি সংঘবদ্ধ চক্র অস্ত্র আনছে। অস্ত্র আসছে ইছামতী নদী হয়ে। দায়িত্বশীল সূত্র মতে, সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশি সন্ত্রাসীদের টার্গেট করেই অস্ত্র তৈরি করা হচ্ছে। পাহাড়ের গহিন জঙ্গলে এসব অস্ত্র কারবারিরা আত্মগোপনে থাকেন। লোকাল প্রযুক্তিতে এসব অস্ত্র তৈরি করা হলেও তার গায়ে লেখা থাকে ‘ইউএসএ’। সিলেটের ওই রুট ব্যবহার করে মাসে অন্তত দুটি চালান আসত। একেকটি চালানে ৩-৫টি অস্ত্র ছিল। পুলিশ সূত্র জানায়, পেশাদার সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কাছে পিস্তলের চেয়ে রিভলবার বেশি পছন্দ। কারণ পিস্তল ব্যবহার করে গুলি করলে অনেক সময় তা ম্যাগাজিনে আটকে যায়। পরে আবার গুলি করতে হলে কয়েক মিনিট সময় লাগে। তবে রিভলবারে একটি গুলি ব্যর্থ হলে পরেরটি সময়ক্ষেপণ ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বের হয়ে যায়। দেশের ব্যবহৃত রিভলবারের ৯৯ শতাংশ ৬ চেম্বারের। তবে এর আগে ডা. জাহিদুল আলম কাদির নামে ময়মনসিংহ থেকে গ্রেফতার হওয়া একজনের কাছে ৮ চেম্বারের রিভলবার পাওয়া যায়। কিশোরগঞ্জের একটি লেদ মেশিনে বিশেষ অর্ডার দিয়ে ওই রিভলবার তৈরি করা হয়েছিল। স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের এডিসি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এই প্রথম ১২ চেম্বারের অত্যাধুনিক রিভলবার জব্দ করা হয়েছে। যে রুট ব্যবহার করে অস্ত্র আসছিল সেটি একেবারে নতুন। অস্ত্র কারবারিরা এই রুট ব্যবহার করছেন তা আগে জানা ছিল না। এ চক্রের অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তদন্তকারীরা দেখতে পেরেছেন যে, গত দুই বছরে চোরাচালানকারীরা আড়াইশর বেশি আগ্নেয়াস্ত্র বাংলাদেশে এনেছে এবং এর প্রধান গ্রাহক হচ্ছে ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা। সূত্র জানায়, সিন্ডিকেটগুলো ভারত থেকে বেশিরভাগ আনে ৭.৬৫ এবং ৯ এমএম পিস্তল এবং .৩২ রিভলভার। তারা একে ২২ এবং একনলা বন্দুকও আনে। তবে এগুলোর চাহিদা বেশি নেই বলে উঠে এসেছে পুলিশ তদন্তে। ভারতে একটি ৭.৬৫ পিস্তলের দাম ২০ হাজার টাকা হলেও বাংলাদেশে তা বিক্রি হয় ৪০-৮০ হাজার টাকায়। ভারতে .৩২ রিভলবারের দাম ২০ হাজার টাকা এবং ৯ এমএম পিস্তলের ৪০ হাজার টাকা। এগুলো এখানে ৭০ থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। গ্রেফতারকৃত সিন্ডিকেটের এক সদস্যদের বরাত দিয়ে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে একটি একে ২২ বন্দুকের দাম প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা এবং ভারতে এর দাম প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর