বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

পলাতক থেকেও ছিল দাপট

জুয়াড়ি দুই ভাই চার দিনের রিমান্ডে

নিজস্ব প্রতিবেদক

পলাতক থেকেও ছিল দাপট

পলাতক থেকেও ক্ষমতার দাপট কমছিল না দুই সহোদর এনামুল হক এনু ও রূপন ভূঁইয়ার। টাকার জোরে তারা ম্যানেজ করে রেখেছিলেন দলের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের। মূলত তাদের হস্তক্ষেপের কারণেই এনু ও রূপন ভূঁইয়া বহিষ্কারাদেশ এড়িয়ে দলীয় কর্মকান্ডে সক্রিয় ছিলেন। দুই ভাইয়ের ভাবনায় ছিল শিগগিরই তারা সবকিছু ম্যানেজ করে আবারও প্রকাশ্যে আসবেন। তবে কিছু দিনের জন্য সীমান্ত পার হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাবেন। গতকাল চার দিনের রিমান্ডে এসে এমনটাই জানিয়েছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির কাছে রিমান্ডে থাকা এনু ও রূপন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির ইকোনমিক ক্রাইম স্কোয়াডের পরিদর্শক  মেহেদী মাসুদ গতকাল সূত্রাপুর থানার অর্থ পাচার মামলার আসামি রূপন ভূঁইয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিন এবং গেন্ডারিয়া থানার অর্থ পাচারের আরেক মামলায় এনামুল হক এনু ও সহযোগী শেখ সানি মোস্তফাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী দুই ভাই এনামুল হক এনু ও রূপন ভূঁইয়াকে চার দিন করে এবং তাদের সহযোগী শেখ সানি মোস্তফাকে তিন দিন রিমান্ডের আদেশ দেন। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির উপ-মহাপরিদর্শক ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করতে পারব। তবে তারা দেশ ত্যাগের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে আসছিল। এ জন্য সবসময় নিজেদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ রেখেছিল।’ রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, আসামি এনামুল হক এনু ও রূপন ভূঁইয়া ক্যাসিনো ব্যবসায়ী। আর তাদের সহযোগী হলেন শেখ সানি মোস্তফা। ক্যাসিনো ব্যবসায় আরও কারা জড়িত সেসব তথ্য জানতে এই আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। এ ছাড়া ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িতদের অর্থের উৎস ও গচ্ছিত অর্থ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো পরিচালনা-সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য এবং মামলার ব্যাপক তদন্তের স্বার্থে আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। এর আগে সোমবার ভোরে ঢাকার কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যায় একটি ১০ তলা ভবনে অভিযান চালিয়ে ৪০ লাখ টাকাসহ ওই তিনজনকে গ্রেফতার করে সিআইডি পুলিশ। জানা গেছে, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের পরিচালক এনু ছিলেন গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। আর তার ভাই রূপন ছিলেন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কয়েকটি ক্লাবের সঙ্গে ওয়ান্ডারার্সে অভিযান চালিয়ে জুয়ার সরঞ্জাম, কয়েক লাখ টাকা ও মদ উদ্ধার করে র‌্যাব। এরই ধারাবাহিকতায় ২৪ সেপ্টেম্বর গেন্ডারিয়ায় প্রথমে এনু ও রূপনের বাড়িতে এবং পরে তাদের এক কর্মচারী ও তাদের এক বন্ধুর বাসায় অভিযান চালিয়ে পাঁচটি সিন্দুকভর্তি প্রায় ৫ কোটি টাকা, আট কেজি সোনা এবং ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। তখন র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, সিন্দুকে পাওয়া ওই টাকার উৎস ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো। টাকা রাখতে জায়গা বেশি লাগে বলে কিছু অংশ দিয়ে সোনা কিনে রাখতেন এনামুল। ওই ঘটনার পর মোট সাতটি মামলা হয়, যার মধ্যে অবৈধ ক্যাসিনো ও জুয়া পরিচালনা এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে চারটি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। সোমবার তিনজনকে গ্রেফতারের পর সিআইডি পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো কারবারের ‘হোতা’ ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা এনু ও রূপন। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তাদের নামে ২২টি বাড়ি ও জমি এবং পাঁচটি যানবাহনের সন্ধান পেয়েছেন তদন্তকারীরা। এ ছাড়া এনামুল ও রূপন গত ছয় থেকে সাত বছরে পুরান ঢাকায় বাড়ি কিনেছেন কমপক্ষে ১২টি। ফ্ল্যাট কিনেছেন ৬টি। পুরনো বাড়িসহ কেনা জমিতে গড়ে তুলেছেন নতুন নতুন ইমারত। স্থানীয় লোকজন জানান, এই দুই ভাইয়ের মূল পেশা জুয়া। আর নেশা হলো বাড়ি কেনা। জুয়ার টাকায় এনামুল ও রূপন কেবল বাড়ি ও ফ্ল্যাটই কেনেননি, ক্ষমতাসীন দলের পদও কেনেন বলে জানা যায়। বাড়িতে র‌্যাবের অভিযানের পর কক্সবাজারে চলে গিয়েছিলেন এনু ও রূপন। সেখান থেকে তারা নৌপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু ওই পথে যেতে না পেরে তারা কেরানীগঞ্জে এসে আশ্রয় নেন এবং ভুয়া পাসপোর্ট তৈরি করান।

ওই পাসপোর্ট নিয়ে ভারত হয়ে তারা নেপালে যাওয়ার পরিকল্পনায় ছিলেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর এই দুই ভাই আলোচনায় আসেন। শুরু থেকেই তারা পলাতক ছিলেন। গতকাল বিকালে রাজধানীর দয়াগঞ্জ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, এনু-রূপনের গ্রেফতারের খবরে সাধারণ মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করলেও তাদের অনেকের মন্তব্য, ‘এদের কেউ আটকে রাখতে পারবে না। টাকার কাছে সব জিরো। গতকাল (সোমবার) তারা গ্রেফতার হয়েছেন, আজ (মঙ্গলবার) পর্যন্ত তাদের বহিষ্কার করা হয়নি। তাদের সব আত্মীয় বহাল তবিয়তেই আছেন।’ আগের ঘটনার স্মৃতিচারণা করে এক বাসিন্দা জানান, তাদের ভয়ে এলাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস করে না। দুই ভাই যখন গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করতেন, তখন মনে হতো তারা এ এলাকার জমিদার। তাদের গাড়িবহর যাওয়ার সময় লোকজন ভয়ে রাস্তা ছেড়ে দিত। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহাম্মদ মোহাম্মদ মন্নাফী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আসলে তাদের নেতারাই তাদের বিভিন্নভাবে টিকিয়ে রেখেছেন। নির্বাচনটা যাক। এর পরই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর