ঢাকা সিটিতে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে দলীয় প্রার্থীকে সমর্থনের ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামের শেষ দিন ছিল বৃহস্পতিবার। দুই সিটিতে শতাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীর কেউই এই আলটিমেটামের পরোয়া করেননি। কাউন্সিলর পদে একক প্রার্থী নিশ্চিত করা যায়নি ক্ষমতাসীন দলে। গতকালও বিদ্রোহীরা ছিলেন নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায়। ফলে অস্বস্তি বাড়ছে আওয়ামী লীগে। দলের দায়িত্বশীল নেতারা জানান, আজকালের মধ্যে বিদ্রোহীরা বসে না পড়লে, দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন না দিলে বহিষ্কার করা হবে।
সূত্রমতে, কাউন্সিলর পদে দলীয় সমর্থন প্রত্যাশীদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে বলা হয়েছিল দলের পক্ষ থেকে। সমর্থন প্রত্যাশী সব প্রার্থীকে গণভবনে ডেকে নিয়ে প্রত্যাহারপত্রে স্বাক্ষর করানো হয় এবং দল যাকেই মনোনয়ন দেবেন, তার পক্ষে কাজ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ২৯ ডিসেম্বর মেয়র ও কাউন্সিলর পদে প্রার্থী ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। পরে কয়েক দফায় সাতজন প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়। প্রথম থেকেই বিদ্রোহী প্রার্থী না রাখার কৌশল নিলেও কাজে আসেনি। ঢাকা উত্তর সিটির সাধারণ ৫৪টি ওয়ার্ডে প্রায় ৫০ জন, দক্ষিণের ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৭০ জন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। তাদের মধ্যে এমপিপুত্র, আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পদধারী নেতারাও রয়েছেন। তারা পুরোদমে গণসংযোগ শুরু করছেন। অনেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। দলীয় প্রার্থীকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের কেউ কেউ দলের একজন শীর্ষ নেতার আশীর্বাদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বলেও প্রচার করছেন। ফলে আওয়ামী বনাম আওয়ামী লীগ মুখোমুখি অবস্থান করায় অনেক ওয়ার্ডে ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে উত্তেজনা। বিদ্রোহীদের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে সামনে ভয়াবহ সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন নেতা-কর্মীরা। দলের জয় নিশ্চিতে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতায় গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার বৈঠক করে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেউ কথা রাখেননি। বরং বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছেন দলের জন্য। এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়ক ও দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন, তাদের আমরা সময় বেঁধে দিয়েছিলাম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে। আর দু-একদিন দেখব। যারা দলের শৃঙ্খলা মানবেন না তাদের বহিষ্কার করা হবে। এ ব্যাপারে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিরিয়াস।’ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে দলীয় সমর্থন পেয়েছেন দক্ষিণখান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সফিউদ্দিন মোল্লা। তাকে চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান নাঈম। একজন কেন্দ্রীয় নেতার আশীর্বাদ নিয়ে তিনি প্রার্থী হয়েছেন বলে এলাকায় প্রচার করছেন। একই সঙ্গে উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার কারণে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক নিয়ে এলাকায় দাপট দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু নিজেই বিদ্রোহী প্রার্থী হননি, আরেকজনকে ডামি প্রার্থী করিয়েছেন বলেও জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মো. সফিউদ্দিন মোল্লা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় আনিসুর রহমান নাঈম বিভিন্ন এলাকা থেকে অপরিচিত লোক নিয়ে এসে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন। অপরিচিত লোকদের আনাগোনায় এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ ব্যাপারে নাঈমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে একাধিকার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। শুধু তাই নয়, দলীয় প্রার্থীকেও নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা এমনকি হত্যার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ প্রার্থী গোলাম আশরাফ তালুকদারকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে থানায় জিডি করেছেন তিনি। এ ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন সাবেক ছাত্রনেতা মামুনুর রশিদ শুভ্র ও শেখ সেকান্দার আলী। সূত্রমতে, কাউন্সিলর পদে যারাই বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন তারা নিজের প্রচারণা নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছেন। মেয়র প্রার্থীকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই তাদের। বরং উল্টো সুরে কথা বলছেন। মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক কিছু নেতা, এমপি ও কিছু প্রভাবশালীর মদদদেই বিদ্রোহীরা মাঠে রয়েছেন বলে জানা গেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম। এ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর মো. হাসান। তিনি হাজী সেলিমের ভাগিনা। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে কাউন্সিলর হয়েছিলেন এবার তাদের কেউ কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণে রয়েছেন ৯ নম্বর ওয়ার্ডে বহিষ্কৃত কাউন্সিলর মমিনুল হক ওরফে সাঈদ, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুন্সী কামরুজ্জামান, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের তারিকুল ইসলাম, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বিল্লাল শাহ, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের ময়নুল হক ওরফে মঞ্জু, ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের দেলোয়ার হোসেন খান, ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল কালাম আজাদ এবং তাদের মধ্যে চাঁদাবাজির মামলায় কারাগারে আছেন ময়নুল হক। উত্তর সিটিতে ৪ নম্বর ওয়ার্ডে জহিরুল ইসলাম, ১৪ নম্বরের ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর হুমায়ুন রশিদ। দক্ষিণের ১ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন খিলগাঁও থানা সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহ-সম্পাদক শাহাদাত হোসেন। ৮ নম্বর ওয়ার্ডে প্রথমে দলের সমর্থন পেয়েছিলেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ইসমাইল জবিউল্লাহ। পরে তাকে বাদ দিয়ে বর্তমান কাউন্সিলর সুলতান মিয়াকে প্রার্থী ঘোষণা করে দল। ফলে ইসমাইল জবিউল্লাহ বিদ্রোহী প্রার্থী রয়ে গেছেন। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে দলীয় প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর মোকাদ্দেস হোসেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের লালবাগ থানার সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন। ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে দলের প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর ওমর-বিন-আবদাল আজিজ। তবে এই ওয়ার্ডে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক সাগর আহমেদ। ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে দলের সমর্থন পেয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. সালেহিন। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আছেন দলের লালবাগ থানার সাবেক নেতা কামাল উদ্দিন (কাবুল)। ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে দলীয় প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর রঞ্জন বিশ্বাসের সঙ্গে বিদ্রোহী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সমিন রায় ও সদস্য বাবুল দাস। ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডে দলীয় প্রার্থী আবুল কালাম অনুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ কে এম ফজলুল হক। ঢাকা উত্তর সিটির ২০ নম্বর ওয়ার্ডে প্রথম দলের সমর্থন পেয়েছিলেন জাহিদুর রহমান। এলাকাবাসীর দাবির মুখে প্রার্থী পরিবর্তন করে এই ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মো. নাছিরকে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু নির্বাচনী মাঠ ছাড়েননি জাহিদুর রহমান। ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন আবদুল্লাহ আল মঞ্জুর। এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মীর আশরাফ উদ্দিন খান ও সাংগঠনিক সম্পাদক মোকছেদ আলী মোল্লা। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে দলীয় সমর্থন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর শামীম হাসান। বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচনী মাঠে আছেন আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ রানা। ৪ নম্বর ওয়ার্ডে দলীয় সমর্থন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর জামাল মোস্তফা। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন। ৬ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন তাইজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ১১ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ থেকে সমর্থন পেয়েছেন বর্তমান ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান। এই ওয়ার্ডে দলের দুজন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। তারা হলেন মিরপুর থানা সাংগঠনিক সম্পাদক মনসুর আলী ও সহ-সভাপতি গাজী আলিয়ার রহমান।