শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

হঠাৎ আলোচনা খালেদার প্যারোল নিয়ে

কাদেরকে ফখরুলের ফোন । প্রধানমন্ত্রীকে বলার অনুরোধ । বিএনপির লিখিত বক্তব্য পাইনি : কাদের । মানবিক কারণে ম্যাডামের মুক্তি চাই : ফখরুল

মাহমুদ আজহার

হঠাৎ আলোচনা খালেদার প্যারোল নিয়ে

হঠাৎ আবারও আলোচনায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ‘প্যারোল’ মুক্তি নিয়ে। বিএনপি-প্রধানের মুক্তি নিয়ে এবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ফোনে সরাসরি কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের গতকাল সকালে গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপি মহাসচিব তাকে ফোন করেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য তারা পাননি। সন্ধ্যায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে বলেন, ওবায়দুল কাদের কী বলেছেন তা তাকেই জিজ্ঞাসা করলে ভালো হবে। এখন প্রশ্ন একটাই, দেশনেত্রীর স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি হয়েছে। তাঁর সুচিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য তাঁর পরিবার থেকেও আবেদন জানানো হয়েছে। এ নিয়ে রাজনীতি কাম্য নয়।

জানা যায়, বেশ কিছুদিন ধরেই বেগম জিয়ার কারামুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছেন, বিএনপির ভিতরে আলোচনা আছে- উন্নত চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি নিয়ে কারাবন্দী খালেদা জিয়া বিদেশ যাবেন। এ নিয়ে বিএনপি ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে বিদায়ী বছরের শেষ দিকে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনা অনেক দূর গড়ায়ও। পরে এ নিয়ে বিএনপির পাঁচ এমপি, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য এমনকি পরিবারের পক্ষ থেকেও বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতে জানানো হয়। কিন্তু বেগম জিয়া তাদের সাফ জানিয়ে দেন, তিনি প্যারোলে মুক্তি নেবেন না। জামিন তাঁর হক। সাংবিধানিকভাবে এটা তাঁর প্রাপ্য। আইনজীবী নেতাদের জামিনের জন্য লড়াই করতে আহ্বান জানান সাবেক প্রধানমন্ত্রী। এর  পরই আলোচনা থমকে যায়। এরপর আবারও বেগম জিয়ার মুক্তি আলোচনা নতুন করে শুরু হয় চলতি সপ্তায়।

জানা যায়, বেগম খালেদা জিয়ার প্যারোলের বিষয়ে শুরুতে ইতিবাচক ছিলেন না তাঁর বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। কিন্তু দিন দিন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে তিনি নিজের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। তার সঙ্গে কথা বলেই বেগম জিয়ার ভাই শামীম এস্কান্দার পরিবারের পক্ষ থেকে বিএনপি-প্রধানের সুচিকিৎসায় বিদেশ পাঠানোর জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। পরিবারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর জন্য এটাই প্রথম লিখিত আবেদন। বিষয়টি স্বীকার করেন বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ ও বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। আবেদন প্রসঙ্গে শামীম এস্কান্দার বলেন, বেগম জিয়ার দ্রুত অবনতিশীল স্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে কোনো অপূরণীয় ক্ষতি এড়াতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত বিদেশি হাসপাতালে চিকিৎসা প্রয়োজন। খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে ব্যয় বহনসহ তাদের দায়িত্বে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে আবেদনে। আবেদনটি বিবেচনা করা হবে বলে আশা করছে পরিবার।

এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার সেজ বোন সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘মেডিকেল বোর্ড যেন বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারকে সুপারিশ করে সেজন্যই এ আবেদন। আবেদনে আমরা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে চেয়েছি। আর বলেছি, খালেদা জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। কারণ, এটা সম্পূর্ণ সাজানো ও মিথ্যা মামলা। সেজন্যই আমরা নিঃশর্ত মুক্তি চেয়েছি।’ খালেদা জিয়া বিদেশ যেতে রাজি হবেন কিনা- এমন প্রশ্নে সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘তাঁর সম্মতি থাকবে। তাঁর অবস্থা এতই খারাপ যে, পাঁচ মিনিটও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। বাঁ হাত সম্পূর্ণ বেঁকে গেছে। ডান হাতের অবস্থাও খারাপ। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। পায়ে কোনো সাপোর্ট রাখতে পারছেন না।’

ওবায়দুল কাদের যা বললেন : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাকে ফোন করেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য তারা পাননি। তা ছাড়া কী কারণে খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর কাছে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো ধরনের লিখিত বক্তব্য যায়নি। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের এ কথা বলেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ডাক্তারদের রিপোর্টের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের মিল নেই। সরকার খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার বিষয়ে আন্তরিক। তাঁকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিব খালেদা জিয়ার মুক্তি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের আবেদনটা জানাতে বলেছেন মৌখিকভাবে। আমি তা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি। আমি এটুকু বলতে পারি, এ ছাড়া কোনো লেনদেন বা কথাবার্তা হয়নি। গতকাল টকশোয় শুনলাম, তলে তলে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমার মনে হয় বাস্তবে বিষয়টা তেমন কিছু নয়।’ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা রাজনৈতিক নয়। তাঁর বিরুদ্ধে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতির মামলা হয়েছে। সে কারণে তাঁর জামিনের বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার, বর্তমান সরকারের নয়।’ বিএনপিকে নেতিবাচক রাজনীতি পরিহার করে ইতিবাচক রাজনীতি করার পরামর্শ দেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, সংঘাত, সন্ত্রাস ও প্রতিহিংসার রাজনীতির দেয়াল ভেঙে ইতিবাচক রাজনৈতিক ধারায় ফিরে এলে বিএনপির জনসমর্থন বৃদ্ধি পাবে। খালেদা জিয়ার দল কিংবা পরিবার যদি আবেদন করে তবে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে- জানতে চাইলে কাদের বলেন, ‘যদিটা পরে দেখা যাবে। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, প্যারোলের আবেদনের সঙ্গে বিষয়টির মিল আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা। তাদের আবেদন খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার জন্য যৌক্তিক কিনা, এ বিষয়টি অবশ্যই দেখা হবে। যেহেতু খালেদা জিয়াকে আদালত দোষী ঘোষণা করেছে, কাজেই মেডিকেল বোর্ডের রিপোর্টটা আদালতের কাছেই যেতে হবে।’ খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে সাংবাদিকদের করা আরেক প্রশ্নের জবাবে সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে অমানবিক কোনো কিছু সরকার করতে পারে না। তাঁকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়টি সরকারের মাথায় আছে। তবে একটা বিষয় হচ্ছে, তাঁর শারীরিক অবস্থার বিষয়টা তাঁর দলের লোকেরা যেভাবে বলেন, চিকিৎসকরা কিন্তু সেভাবে বলছেন না।’ বিএনপির ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদককে ফোন করা ও সরকারকে আন্দোলনের হুমকি বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘এটা বিএনপির দ্বিচারিতা।’ সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, আফজাল হোসেন, প্রচার সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, উপদফতর সম্পাদক সায়েম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

মির্জা ফখরুল যা বললেন : মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সরকার বা অন্য কারও এখন আর এগুলো নিয়ে রাজনীতি না করে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে তাঁকে মুক্তি দেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। দুই বছর ধরেই আমরা এ দাবি নিয়ে কোর্টে ও রাস্তায় নামছি, চিৎকার করছি। দেশবাসী এ মুহূর্তে ম্যাডামের মুক্তি চায়। একই সঙ্গে আজকে তাঁর (খালেদা জিয়া) পরিবারও দাবি করছে। কয়েকদিন আগেই তারা (পরিবার) লিখিতভাবে বিএসএমএমইউর ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের জন্য তারা চিঠি দিয়েছেন। আর বাকি প্রশ্নগুলো সব অবান্তর। এগুলো আর প্রশ্ন থাকে না।’

আবার খালেদার জামিন আবেদন : আগামী সপ্তাহে খালেদা জিয়ার জামিন চেয়ে আবার আবেদন করবেন তাঁর আইনজীবীরা। গতকাল বিকালে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সঙ্গে বৈঠকের পর সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আবার ম্যাডামের জামিনের দরখাস্ত করব। আমরা বিশ্বাস করি, হাই কোর্ট দেশের জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল। সেখানে আমরা এবার জামিনের আবেদন যদি করি, অবশ্যই জামিন লাভ করব।’ কবে নাগাদ জামিন আবেদন করবেন- জানতে চাইলে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে আগামী সপ্তাহে এ সিদ্ধান্ত নেব।’ গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে গতকাল বিকালে জাতীয় স্থায়ী কমিটিসহ সিনিয়র আইনজীবীদের এ বৈঠক হয়। লন্ডন থেকে স্কাইপেতে যুক্ত হন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার সভাপতিত্বে মির্জা ফখরুল ছাড়াও বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের মধ্যে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর