মঙ্গলবার, ৩ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা
ঢাকায় সেমিনারে হর্ষবর্ধন শ্রিংলা

এনআরসি বাংলাদেশে প্রভাব ফেলবে না

অভিন্ন ছয় নদীর পানি বণ্টন চুক্তির সম্ভাবনা

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

এনআরসি বাংলাদেশে প্রভাব ফেলবে না

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে থাকা অভিন্ন নদ-নদীগুলোর পানি বণ্টনের চুক্তি এ বছরই স্বাক্ষর হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। তিনি বলেন, অভিন্ন নদ-নদীগুলোর তথ্য হালনাগাদ করে তা সমন্বয়ের চেষ্টা চলছে। সম্ভবত এ বছরের মধ্যে চুক্তি হবে। তিনি গতকাল ঢাকায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে এ তথ্য জানান। এ ছাড়া ভারতের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) প্রতিবেশী দেশে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলেও মন্তব্য করেছেন শ্রিংলা। অবশ্য ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, তিস্তার বাইরে অন্য ছয়টি নদ-নদীর পানি বণ্টন নিয়ে মোদির সফরে চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনার কথা শ্রিংলা বলেছেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে গতকাল প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসা শ্রিংলা আজ ঢাকা ত্যাগ করবেন।

দুই দিনের সফরের প্রথম দিনে সকালে ‘বাংলাদেশ ও ভারত : একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। পরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে আলাদা সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস-বিস) ও ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন যৌথভাবে আয়োজিত এ সেমিনারে শ্রিংলা বলেন, ঢাকায় আসতে পারা আমার জন্য খুবই আনন্দের। কারণ ঢাকা আমার কাছে নিজের শহরের মতোই। ঢাকা ও বাংলাদেশের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আমি হাইকমিশনার হিসেবে এখানে কাজ করেছি এবং আমার কর্মজীবনের অন্যতম সন্তুষ্টিদায়ক নিয়োগ ছিল এটি।

সেমিনারের মূল প্রবন্ধে শ্রিংলা বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চলতি মাসে মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমরা এ সফরের আশায় আছি। কারণ বঙ্গবন্ধু একজন বিশ্বনন্দিত নেতা এবং বাংলাদেশ ও আমাদের উপমহাদেশের মুক্তির প্রতীক। ভারতে তাঁর নাম বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তিনি বাংলাদেশে যেমন সম্মান লাভ করেন তেমন ভারতেও সমান শ্রদ্ধার পাত্র। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান আমাদেরও জাতীয় বীর। তাই বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে যৌথ প্রযোজনায় বিশেষ চলচ্চিত্র নির্মাণসহ জন্মশতবর্ষের বিভিন্ন আয়োজনের অংশীদার হতে পেরে আমরা গর্বিত।

তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, অভিন্ন নদ-নদীগুলোর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে দুই দেশেরই আগ্রহ রয়েছে। অভিন্ন নদ-নদীগুলোর পানির তথ্য হালনাগাদ করে সমন্বয়ের প্রক্রিয়া চলছে। এ বছরের মধ্যেই অভিন্ন নদ-নদীগুলোর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা আছে। তিনি বলেন, ‘এটা প্রমাণিত যে, ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর পানি পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও ন্যায্য বণ্টন করার মধ্যেই আমাদের বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ নিহিত। আমাদের দুই পক্ষই স্বীকার করে যে, অভিন্ন নদ-নদী বিষয়ে আমাদের আরও উন্নতির সুযোগ আছে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গত আগস্টেই দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপ শুরু হয়েছে।

ভারতের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) প্রসঙ্গে শ্রিংলা বলেন, নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে এবং অনেক অভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারা থাকায় এটাও অস্বীকার করা যায় না যে, আমাদের দুই দেশেরই কিছু ঘটনা কারণে বা অকারণে সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো আসামে নাগরিকপঞ্জি হালনাগাদকরণ, যে প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়েছে। এখানে আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বারবার বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আশ্বস্ত করেছেন যে, এ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সুতরাং বাংলাদেশের জনগণের ওপর এর কোনো প্রভাব থাকবে না। আমরা এ ব্যাপারে আপনাদের আশ্বস্ত করছি। তিনি বলেন, প্রথমত, নাগরিকত্ব বিল কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। দ্বিতীয়ত, নির্যাতনের শিকার হয়ে এসে যারা ভারতে আছেন, তাদেরকে দ্রুততার সঙ্গে নাগরিকত্ব দেওয়া এর উদ্দেশ্য। এবং তৃতীয়ত, এটি (বাংলাদেশের) বর্তমান সরকারের সময়ের জন্য কার্যকর হবে না। কার্যকর হবে ১৯৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসক ও অন্য সরকারগুলোর সময়ে, যারা এখানে সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকার দেয়নি। ‘মানবিক বিবেচনা’ থেকেই ভারত সরকার নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করেছে দাবি করে দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বর্তমানে হাজার হাজার মানুষ আছে, যারা ঘরবাড়ি ও রাষ্ট্রহীন। তারা নাগরিকত্ব পাবে। আগে যেখানে ১০ বছর লাগত, সেখানে এখন লাগবে পাঁচ বছর। এখন যারা বাদ পড়েছেন তারা ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে পারবেন। পরে যেতে পারবেন ভারতের হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে। এ দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার কারণে এ মুহূর্তে বাংলাদেশে এটার প্রভাব নিয়ে বিচলিত হওয়ার কারণ নেই। যেহেতু এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যু, তাতে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারতের ভূমিকা প্রসঙ্গে শ্রিংলা বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মানবিক সংকট এবং বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব বিষয়ে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে অনেকের আগ্রহ এবং ভিত্তিহীন ধারণাও আছে। ভারত বাংলাদেশের মানবিকবোধের গভীর প্রশংসা করে, যার কারণে তারা প্রায় ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। আপনারা যে বোঝা বহন করছেন, আমরা তা স্বীকার করি এবং সমবেদনা জানাই। আমরাই বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়েরই একমাত্র সত্যিকার বন্ধুদেশ। যেখানে অন্য দেশগুলো চায় আপনারা এ সমস্যা অনির্দিষ্টকালের জন্য বয়ে চলুন, সেখানে আমরা পারস্পরিক গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে একটা সমাধান চাই এবং এই বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোর রাখাইনে দ্রুত প্রত্যাবাসন ও সম্মানজনক জীবন ফিরে পেতে সহায়তা করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। এ প্রত্যাবাসন হতে হবে নিরাপদ ও টেকসই। মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের শিবির গুটিয়ে নেওয়া, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে সহায়তা করা এবং বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য একটা উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির ওপর গুরুত্ব দিয়ে এ বিষয়গুলো নিয়ে ভারত দেশটির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিশাল মানবিক সংকট মোকাবিলায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ বিষয়ে আমাদের পরামর্শ হলো, আমরা সবাইকে উদ্বুদ্ধ করব বাগাড়ম্বর না করে যেন এ সমস্যার একটি মানবিক ও বাস্তবসম্মত সমাধানের প্রতি গুরুত্ব দেয়।

সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী। উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাশ, বিসের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি এম ফজলুল করিম ও বিসের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক কর্নেল শেখ মাসুদ আহমেদ।

সীমান্ত হত্যা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্বেগ : সফররত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার কাছে সীমান্ত হত্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। সফররত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা গতকাল সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে এ আহ্বান জানান তিনি। বৈঠক শেষে মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, আমি বললাম, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমাদের জিরো কিলিং হবে বর্ডারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ বছরে কিলিংটা অনেক বেড়ে গেছে, এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক। আমি বললাম, আপনারা আমাদের বন্ধু মানুষ। এই বন্ধুদের মধ্যে কিলিং হওয়া ঠিক নয়। জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সীমান্ত হত্যা বন্ধে ‘চেষ্টা চালাবেন’ বলে আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সাক্ষাতে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়েও আলোচনা হওয়ার কথা জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি বললাম যে, আমাদের তিস্তা আপনারা বললেন যে, সবকিছু রেডি আছে, কিন্তু এখনো এটা শেষ হলো না। উনি বললেন যে, মোটামুটি এটাতে অসুবিধা আছে উনাদের, কিন্তু আশা করছি, এটা আগামীতে হবে। আমি বললাম যে, আমাদের জবাবদিহি আছে, আমরা একটি নির্বাচিত সরকার। গণতান্ত্রিক সরকার, মানুষ আমাদের এগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তোমাদের বন্ধুত্ব, কিন্তু কাজ হচ্ছে না তো।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, উনি বললেন যে, আরও কয়েকটি নদী আছে, সেটা আমরা মোটামুটি ফাইনালাইজড করে ফেলেছি এবং আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী মোদি এলে পরে কিছু একটা হতে পারে। কারণ আপনারা গতবারে আমাদের ফেনী নদীর কিছু সাহায্য করেছেন এবং এখন ভারতের প্রয়োজন আপনাদেরকে সাহায্য করা। বললাম, দিস ইজ গুড। উনি বললেন, এবার আমরা আপনাদের প্রতিদান দিতে চাই। ভারতে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে চলমান সহিংসতার বিষয়টি আলোচনায় তোলার কথা জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, তোমাদের দেশের অনেক ইস্যু আছে, যেগুলো আমাদের দেশে সময়ে সময়ে চিন্তার কারণ হয়। উদ্বেগ আমাদের জনগণও করে এবং সেই জনগণের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হয়। সেসব সম্পর্কে আমরা চাই তোমরা এমন কোনো কাজ করবা না, যাতে আমাদের অসুবিধার সৃষ্টি হয়। উনি (শ্রিংলা) বললেন যে, ইস্যুগুলো কোনোভাবে বাংলাদেশকে অ্যাফেক্ট করবে না। ইস্যুগুলো অল্প দিনের জন্য, উনি জাস্টিফাই করতে চাইলেন, এগুলো কেন করার দরকার পড়ল।

সর্বশেষ খবর