বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ঊনসত্তরের ডিসেম্বরে, যখন তিনি কক্সবাজার যাচ্ছিলেন। আমার কাছে আওয়ামী লীগের সবাই এলেন চাঁদার জন্য। চাঁদা দিয়ে আমি তাদেরকে অনুরোধ করলাম- ‘বঙ্গবন্ধুর সম্মানে তোমরা আমার হোটেলে একটা নৈশভোজের আয়োজন কর। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে নাগরিক সংবর্ধনা দাও।’ তারা খুশিমনে রাজি হলেন। সেই নৈশভোজে প্রথম বঙ্গবন্ধুর পাশে বসার বিরল সম্মান পেলাম। প্রথম দেখাতেই বঙ্গবন্ধু আমায় পছন্দ করেন এবং বুকে জড়িয়ে ধরেন। সেদিন আওয়ামী লীগ নেতাদের বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে ১৫১টি আসন এনে দাও, আমি দেখিয়ে দেব।’ তিনি জানতেন পাকিস্তানিরা ক্ষমতা দেবে না, তিনি শুধু জাতির ম্যান্ডেট নিতে চেয়েছিলেন। তখন আমাদের এখানে জাতীয় পরিষদের ছিল ১৬২টি আসন, পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ১৩৮টি আসন। মোট ৩০০ আসনের মধ্যে সত্তরের নির্বাচনে ১৬০টি আসন পাই আমরা। আমরা পার্লামেন্টের মেজরিটি হলাম। মেজরিটি পার্টির নেতা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিয়ম অনুযায়ী তাঁকে সরকার গঠনের জন্য ডাকার কথা। নির্বাচন হয়েছে, ৩ মার্চ পরিষদের অধিবেশন ডাকা হলো। ভুট্টো হুমকি দিয়ে বললেন, ‘ওইদিন অ্যাসেম্বলি কসাইখানায় পরিণত হবে।’ ইয়াহিয়া অধিবেশন স্থগিত করে দিলেন। সারা দেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। বঙ্গবন্ধু তখন ৭ মার্চের ভাষণ দিলেন। সে ভাষণকে আজ ইউনেস্কো বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
 বঙ্গবন্ধু বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিলেন না। সেদিন ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে ফিরে যাও। হত্যা বন্ধ কর। আমার মানুষের উপর অত্যাচার কোরো না।’ আর বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি সংগ্রাম চালিয়ে যাও, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। যতক্ষণ পর্যন্ত একটা শত্রুও থাকে তার সাথে লড়াই কর।’ এ বার্তাটাই তো স্বাধীনতার ঘোষণা। তাঁর ভাষণের পর সারা দেশে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেলাম। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে স্বাধীনতা পেতাম না।
বঙ্গবন্ধু বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিলেন না। সেদিন ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে ফিরে যাও। হত্যা বন্ধ কর। আমার মানুষের উপর অত্যাচার কোরো না।’ আর বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি সংগ্রাম চালিয়ে যাও, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। যতক্ষণ পর্যন্ত একটা শত্রুও থাকে তার সাথে লড়াই কর।’ এ বার্তাটাই তো স্বাধীনতার ঘোষণা। তাঁর ভাষণের পর সারা দেশে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেলাম। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে স্বাধীনতা পেতাম না।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরই আমরা সীতাকুন্ড ও মিরসরাইয়ের জনগণ এক প্রকার যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলাম। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার আবার দেখা হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। তখন চট্টগ্রাম-ঢাকা যোগাযোগের একটা মাত্র লিঙ্ক ছিল শুভপুর ব্রিজ। আমি ব্রিজটি উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে বললাম, ব্রিজটি উড়িয়ে দিতে কিছু এক্সপ্লোসিভ জোগাড় করতে চাই। শুনেই বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘শাবাশ! তুই এক্সপ্লোসিভ জোগাড় কর, অর্ধেক নিয়ে যাবি, সময়মতো শুভপুর ব্রিজ উড়িয়ে দিবি। বাকি অর্ধেক আমার বাসায় রেখে যাবি।’ উনার মাথায় যুদ্ধের প্রস্তুতি না থাকলে এ কথা বলতেন না। একদিকে আলোচনা করছিলেন, অন্যদিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমি এক্সপ্লোসিভ জোগাড় করতে ছাতক পর্যন্ত গেলাম, কিন্তু পারলাম না। এর মধ্যে নেতারা আমাকে বললেন, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টকে শক্তিশালী করতে ২৬ ট্রাক আর্মি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসছে। শুনেই আমি লোকজন নিয়ে মিরসরাই যাই। তখন সন্ধ্যা ৭টার মতো। নেতা-কর্মীদের নিয়ে পেট্রোল, ডিজেল দিয়ে ব্রিজটির কাঠের অংশ পুড়িয়ে দিলাম। বন্ধ হয়ে যায় চট্টগ্রাম প্রবেশের রাস্তা। চট্টগ্রাম শহরে ফিরে দেখলাম পুরো শহর লোকারণ্য। আমি সবাইকে বললাম, যার যা কিছু আছে সব নিয়ে আসো। ২৬ ট্রাক পাকিস্তান আর্মি আসছে, প্রতিরোধ করতে হবে। রাস্তা বন্ধ করে দিতে হবে। লোকজন গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করল। রাত ১২টায় আমি যখন শহরের রেলস্টেশনে পৌঁছলাম তখন স্টেশনমাস্টার আমাকে ইশারা দিয়ে দাঁড় করিয়ে বললেন, বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসের মাধ্যমে মধ্যরাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন যতক্ষণ পর্যন্ত একজন পাক সেনা এ দেশে থাকবে ততক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে।
২৫ মার্চ পাকিস্তান আর্মি যাকে যেখানে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা লিফলেট আকারে মানুষের মধ্যে বিতরণ করি এবং অফিস পিয়ন নূরুল হককে দিয়ে মাইকে প্রচার চালাই। ২৬ মার্চ দুপুর ১টার দিকে আমরা একটা জিপে করে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গেলাম। এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার যে ঘোষণাটি আগেই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠ করেছিলেনে সেটি সুন্দর করে লিখে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে আবার বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা দিলাম। লেখক : মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। অনুলেখক : শামীম আহমেদ।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        