শনিবার, ২১ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

পর্যাপ্ত মজুদের পরও বেড়েছে চালের দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক

খাদ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, সরকারের হাতে মজুদ রয়েছে ১৪ লাখ ২৯ হাজার টন চাল। যে কোনো আপৎকাল মোকাবিলায় এ পরিমাণ চাল যথেষ্ট। এ ছাড়া সামনেই বোরো মৌসুম। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে ধান কাটা ও মাড়াই। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ও মিলমালিকদের কাছেও বিপুল পরিমাণ চালের মজুদ রয়েছে। শুধু রাজশাহী, নওগাঁ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মিলমালিকদের হাতেই অন্তত ১ কোটি টন চাল মজুদ রয়েছে। এর বাইরে সারা দেশে ধনাঢ্য কিংবা মধ্য শ্রেণির কৃষকের ঘরে ঘরেও রয়েছে নিজেদের প্রয়োজনীয় চালের মজুদ। এর পরও করোনাভাইরাস আতঙ্কের সুযোগ কাজে লাগিয়ে দফায় দফায় চালের দাম বাড়াচ্ছেন মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা সত্য যে, করোনা আতঙ্কের কারণে মানুষ কিছুটা অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। এ কারণে তারা ঘরে কিছু খাদ্যপণ্য মজুদ করছে। ফলে এক সপ্তাহে চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। আর এ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে অসৎ ব্যবসায়ীরা চালের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছেন। দফায় দফায় দাম বাড়ছে। অথচ সরবরাহ চেইনে কোথাও কোনো সংকট নেই। শুধু তা-ই নয়, এ সুযোগে নিত্যপণ্যের বাজারে কোনো সংকট না থাকা সত্ত্বেও পিয়াজ, ডিম, মসুর ডালসহ অনেক পণ্যেরই দাম বেড়ে গেছে। এমনকি ডিম ও পিয়াজের দাম বাড়ছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। আগের দিন রাতে প্রতি ডজন ডিম ১০৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সে ডিম গতকাল সকালে বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকায়। আবার গতকাল বিকালে কোথাও কোথাও ১২৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তাদের আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যারা কোনো কারণ ছাড়াই অতিরিক্ত চাল, ডাল, পিয়াজ কিনে মজুদ করছেন, তারা তাদের মজুদ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। রাজধানীসহ সারা দেশের চালের আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে ১২ টাকা বেড়েছে। গতকাল রাজধানীর কোথাও কোথাও ৬৬ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে মিনিকেট চাল। এ চাল মাত্র তিন দিন আগে বিক্রি হয়েছিল ৫২ থেকে ৫৪ টাকায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাদামতলী ও বাবুবাজার চাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. নিজাম উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেজিতে ৪-৫ টাকা বেড়েছে। এটা তেমন কিছু না। সংকটকালে চালের সরবরাহ যেন ঠিক থাকে সেটাই আপনাদের লেখা উচিত। পাইকারি বাজারে তো তেমন দাম বাড়েনি। খুচরা বাজারে বেড়েছে। সেখানে সরকারের নজরদারি দরকার।’ তিনি বলেন, ‘এ সংকটকালে দাম বাড়লেও চাল যে পাওয়া যাচ্ছে সেটাই তো বেশি। ফলে আপনাদের এগুলো লেখা উচিত যে দাম বেশি হলেও চাল পাওয়া যাচ্ছে।’ তবে এক সপ্তাহের মধ্যেই বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে তিনি জানান। আর সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের প্রধান খাদ্য ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, আটা ও শাকসবজি। এগুলো সবই আমাদের অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত। ফলে নিত্যপণ্য নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। এ মুহূর্তে দেশে অন্তত এক বছরের প্রয়োজনীয় খাদ্য মজুদ রয়েছে। আর যারা হঠাৎ করে দাম বাড়িয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই সুযোগসন্ধানী।’ জানা গেছে, বাজারে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে রশিদ ও মোজাম্মেল ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের দাম। এ চাল সপ্তাহের শুরুতে ছিল প্রতি বস্তা ২ হাজার ৫০০ টাকা। এখন হয়ে গেছে ২ হাজার ৮০০ টাকা। খুচরায় এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজিতে, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫৩ টাকা। বাসমতী চালের দাম কেজি ৬৫ থেকে বেড়ে ৭০ টাকা হয়েছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী : সপ্তাহের ব্যবধানে ঊর্ধ্বমুখী মাছ, মুরগি ও সবজির বাজার। বেড়েছে চাল ও পিয়াজের দামও। কেজিতে ১০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে মাছের দাম। কেজিতে ৫ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে সবজির দাম। দাম বেড়েছে মুরগিরও। এ ছাড়া আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে গরু, মহিষ ও খাসির মাংস এবং তেল ও মশলা। শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, খিলগাঁও, মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি বাজার, ফকিরাপুল কাঁচাবাজার এবং শান্তিনগর কাঁচাবাজার ঘুরে এসব চিত্র পাওয়া গেছে। মাছ, মুরগি ও সবজির মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে ভিন্নমত দেখা গেছে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে। বিক্রেতারা বলছেন, করোনা আতঙ্কে বাজারে পণ্যের সরবরাহ কমায় দাম বেড়েছে পণ্যের। আর ক্রেতারা বলছেন, করোনা আতঙ্ক নয়, বিভিন্ন সমস্যায় ব্যবসায়ীরা জনগণের পাশে না থেকে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। বাজারে পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি না থাকলেও দাম বাড়ানো হয়েছে। গতকাল বাজারে দেশি পিয়াজ কেজি বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৭৫ টাকা, যা বুধবারও ৪০-৪৫ টাকা ছিল। এসব বাজারে দেশি রসুনের কেজি বিক্রি হতে দেখা যায় ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়, যা দুই দিন আগে ছিল ৭০-৮০ টাকা। আমদানি করা রসুন বিক্রি হয়েছে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা, যা বুধবার ছিল ১৪০-১৫০ টাকা। ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া আদার দাম বেড়ে হয়েছে ১৭০-১৮০ টাকা। আর ১৮-২০ টাকা কেজির গোল আলু বিক্রি হয়েছে ২৫-২৮ টাকায়। বেড়েছে সবজির দামও। কেজিপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়ে আকারভেদে চিচিঙ্গা ১০০-১২০, শিম ৫০-৬০, টমেটো ৪০-৬০, কাঁচামরিচ ১০০-১২০, করলা ৮০-১১০, উস্তা ১২০, বেগুন ৬০-১০০, গাজর ৪০-৬০, পেঁপে ৩০-৪০, কচুর লতি ৮০-১০০, বড় কচু ৫০-৬০, বিট ৪০-৬০ ও শসা ৪০-৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়ে প্রতি পিস লাউ বিক্রি হয়েছে ৬০-৮০, চালকুমড়া ৫০, প্রতি পিস বাঁধাকপি ৪০-৫০, ফুলকপি ৬০-৮০ টাকা। বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৪০, লেয়ার ২২০-২৩০, সাদা লেয়ার ১৮০-২০০, সোনালি ২৬০-২৮০ টাকা। দাম বেড়েছে মাছেরও। এসব বাজারে ১ কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১১০০-১২০০, ৭৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০০-৭৫০, ছোট ইলিশ আকারভেদে ৪০০-৪৫০ টাকা কেজি দরে। এ ছাড়া প্রতি কেজি কাঁচকি ৩৫০-৪০০, মলা ৩৫০-৪০০, ছোট পুঁটি (তাজা) ৫০০-৫৫০, শিং ৪০০-৬৫০, পাবদা ৪০০-৫৫০, গলদা চিংড়ি ৪৫০-৭৫০, বাগদা ৪৫০-৯৫০, দেশি চিংড়ি ৩৫০-৫০০, রুই (আকারভেদে) ২৫০-৩৫০, মৃগেল ২২০-৩৫০, পাঙ্গাশ ১৩০-১৮০, তেলাপিয়া ১৫০-২০০, কই ২০০-২২০, কাতল ২২০-৩২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, করোনাভাইরাসের কারণে আতঙ্ক ছড়িয়ে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এতে আতঙ্কিত হয়ে অনেকে বাড়তি দামেই চাহিদার অতিরিক্ত পণ্য কিনে মজুদ করে রাখছেন। যার প্রভাবে বাজারে পণ্যের সংকট তৈরি হতে পারে। এ অবস্থায় পরিবারপ্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা প্রশাসন। শুক্রবার বিকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সফি উল্লাহ এক বিজ্ঞপ্তিতে পণ্যের এ পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একটি পরিবারের বাজারকারী প্রতি বাজারে ১ বস্তা চাল, ২ কেজি পিয়াজ, ১ কেজি ছানাবুট, ২ কেজি আলু, ১ কেজি ডাল, ২ লিটার তেল ও ১ কেজি রসুন কিনতে পারবেন। যদি নির্ধারণ করে দেওয়া পরিমাণের বেশি পণ্য কোনো ব্যক্তি কেনেন তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে হবে।

সর্বশেষ খবর