শনিবার, ৪ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকারে র‌্যাবের এডিজি কর্নেল তোফায়েল

চিকিৎসায় অনিয়ম সহ্য করা হবে না

সাখাওয়াত কাওসার

চিকিৎসায় অনিয়ম সহ্য করা হবে না

হাসপাতালের কোনো সুবিধা ছাড়াই ভয়ঙ্কর ভাইরাস করোনার সফল মোকাবিলা করছে এলিট ফোর্স র‌্যাব। বাহিনীর ২০ শতাংশ সদস্য আক্রান্ত হলেও ইতিমধ্যে ৮০ শতাংশ সুস্থ হয়ে কাজে ফিরে গেছেন। বাকিরা সুস্থ হওয়ার পথে। আর এটা হয়েছে সঠিক ব্যবস্থাপনার কারণে। র‌্যাবের করোনা মোকাবিলার পদ্ধতি অনুসরণ করে এরই মধ্যে সিলেটে দুটি কভিড হাসপাতাল হয়েছে। প্রশংসা করেছে দেশ-বিদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে র‌্যাব সদর দফতরে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলছিলেন র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি-অপস্্) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার। র‌্যাবে যোগদানের পর থেকে ক্যাসিনো সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি, মাদক এবং জঙ্গিবিরোধী অভিযানে একের পর এক নেতৃত্ব এবং দিকনির্দেশনা দিয়ে এরই মধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছেন চৌকস এই কর্মকর্তা। অভিযান এবং সফলতার দিক দিয়ে মাঝে বেশ কিছু দিন ঝিমিয়ে পড়লেও আবার নড়েচড়ে বসেছে র‌্যাব। তিনি কথা বলেছেন কভিড-১৯ ভাইরাসের সচেতনতাসহ নানা বিষয় নিয়ে। হাসপাতালের চিকিৎসার অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির বিষয়েও নজর রাখা হচ্ছে জানিয়ে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনিয়ম-দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। প্রয়োজনে র‌্যাবের মোবাইল কোর্ট দিয়ে অভিযান চালানো হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : র‌্যাবের করোনা মোকাবিলার পদ্ধতি নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। এত কম ক্ষয়ক্ষতিতে কীভাবে করোনা মোকাবিলা করলেন? আগামী দিনগুলোতে র‌্যাবের অবস্থান কী হবে?

এডিজি : দেখুন, র‌্যাব ফোর্সেস একটা বিশেষায়িত বাহিনী। সে হিসেবে আমাদের অনেক সুবিধা যেমন রয়েছে তেমন কিছু অসুবিধাও আছে। যেমন আমাদের নিজস্ব কোনো হাসপাতাল নেই। আমরা বিভিন্ন বাহিনীর হাসপাতালে ভর্তি হই। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন হাসপাতাল তাদের নিজস্ব বাহিনীর রোগী নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে। ফলে করোনা মহামারী যখন বিশ্বকে আঘাত করে এবং বাংলাদেশে সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই আমরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। আমরা বিবেচনায় নিয়েছি যে, আমাদের ডাক্তারের সংখ্যা হাতেগোনা। আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, অপারেশন কার্যক্রম আগের গতিতে চাঙ্গা রেখেই করোনাকে আমরা মোকাবিলা করব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে মৃদু ও মাঝারি সংক্রমিত রোগীদের চিকিৎসা শুরু করি আইসোলেশন সেন্টারে। আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, হালকা এবং মাঝারি সংক্রমিত রোগীদের আমরা বড় হাসপাতালে দেব না। তাহলে বড় হাসপাতালের চিকিৎসকরা জরুরি রোগীদের ওপর বেশি মনোনিবেশ করতে পারবেন। ফলে মৃত্যুর হার কমবে।

বা. প্র. : কেমন প্রস্তুতি ছিল?

এডিজি : আমরা আইসোলেশন সেন্টারগুলোকে সিসি ক্যামেরার আওতায় এনেছি। প্রতিটি ব্যাটালিয়নে একটি করে আইসোলেশন সেন্টার তৈরি আমরা নিশ্চিত করেছি যেন একজন রোগী পাঁচ মিনিটের বেশি অক্সিজেন স্বল্পতায় না ভোগে। সময়মতো যেন অক্সিজেন দিতে পারি। আমাদের গুটিকয়েক চিকিৎসক ও আমরা করোনা আক্রান্ত রোগীদেরই প্রশিক্ষিত করেছি। কীভাবে অক্সিজেন লেভেল মাপতে হয়। কীভাবে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ফিট করতে হয়। ফলে একজন রোগী তার পাশের বেডের আরেক রোগীকে সাহায্য করেছে। একজন নার্সকে সারা দিন-রাত অপেক্ষায় থেকে ডিউটি করতে হয়নি। ডাক্তার এসে দেখেছেন রোগী ঠিকমতো অক্সিজেন নিতে পারছে। প্রত্যেকের কাছে গরম পানির ভাপ নেওয়ার ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ব্যবস্থাপত্র সহজলভ্য করা হয়েছে। চিকিৎসক এবং প্যারামেডিক্স ভাড়া করেছি।

বা. প্র. : যতদূর জেনেছি র‌্যাবে মাত্র তিনজন চিকিৎসক রয়েছেন। এত অল্প চিকিৎসক দিয়ে কীভাবে এ অবস্থার মোকাবিলা করলেন?

এডিজি : আমরা আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে কিছু সংখ্যক চিকিৎসক এবং প্যারামেডিক্স নিয়েছি। করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে র‌্যাবের অ্যাপসটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। (বড় পর্দায় সেই অ্যাপসটির সংক্রমণের ডিজিটাল গ্রাফ দেখিয়ে তিনি বলেন) যে ব্যাটালিয়নে সংক্রমণ নিচের দিকে চলে আসছিল সেখান থেকে চিকিৎসাসামগ্রী অন্য ব্যাটালিয়নে যেখানে সংক্রমণ উপরের দিকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতি ১৫ মিনিট পর পর র‌্যাবের নিজস্ব অ্যাপসে করোনা পরিস্থিতির আপডেট করা হচ্ছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারলে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে আমাদের মনে হয়েছে। করোনায় চিকিৎসার চেয়ে ব্যবস্থাপনাটাই বেশি জরুরি। একজন করোনা আক্রান্ত র‌্যাব সদস্যকে বরিশাল থেকে হেলিকপ্টারে করে সংকটাপন্ন অবস্থায় ঢাকায় আনা হয়েছে। তার অক্সিজেন লেভেল ৫০ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা হেলিকপ্টারেই রিচার্জেবল অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ব্যবহার করেছি। তাকে যখন ঢাকায় আনা হয় তখন চিকিৎসকরাই অবাক হয়ে বলেছেন, এই রোগীকে আপনারা কীভাবে বাঁচালেন! সেই সদস্য কিন্তু এখন পুরোপুরি সুস্থ। গণমাধ্যমের সহায়তা নিয়ে তাকে প্লাজমাও দেওয়া হয়েছে। র‌্যাবের যেসব সদস্য সেরে উঠেছে তারাও চাহিদা অনুসারে এখন প্লাজমা দিচ্ছেন। 

সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে করোনা পরিসংখ্যান র‌্যাব থেকে সরবরাহকৃত তথ্যে দেখা যায়, গতকাল পর্যন্ত র‌্যাবে মোট করোনা সংক্রমিত হয়েছেন ১৮৭৬ জন। এরই মধ্যে ১৫০৯ জন সুস্থ হয়েছেন। আইসোলেশনে রয়েছেন ৩৬৭ জন। সে অনুসারে সুস্থ হয়েছেন ৮০ ভাগ। তিনজন র‌্যাব সদস্য আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

কর্নেল তোফায়েল বলছিলেন, শুরুর দিকে আমরা লক্ষ্য করি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে, আতঙ্কে যত মানুষ মারা যাচ্ছে সত্যিকার অর্থে করোনায় তত মানুষ মারা যাচ্ছে না। আমাদের তিনজন র‌্যাব সদস্য একেবারে শুরুর দিকে রিপোর্টে কভিড পজিটিভ শোনার পরপরই আতঙ্কে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আমরা বাহিনীর সদস্যদের মনোবলটা ভাঙতে দিইনি। করোনায় র‌্যাবের অপারেশনও ভেঙে পড়েনি।

বা. প্র. : করোনা মোকাবিলায় র‌্যাবের মডেল যেটি সফল বলে আপনারা দাবি করছেন সেই মডেলটি আপনারা পুলিশের সঙ্গে বা অন্য কোনো বাহিনীর সঙ্গে বিনিময় করেছেন?

এডিজি : হ্যাঁ, আমরা করেছি। তবে এই যে সংক্রমণ কমিয়ে আনার মডেল এখানে কিন্তু কারও একার কৃতিত্ব নেই। এখানে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আছে। তবে একটা কথা বলতে পারি, একজন র‌্যাব সদস্যও বলতে পারবেন না যে, তিনি সময়মতো ওষুধ বা গরম পানি অথবা আনুষঙ্গিক জিনিস পাননি।

বা. প্র. : করোনার সময় গুজব বা জঙ্গিবাদের বিস্তার নিয়ে কথা হচ্ছে।

এডিজি : দেখুন, লকডাউনে মানুষ ঘরের মধ্যে দীর্ঘ সময় বসেছিল। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গুজব বা জঙ্গিবাদে দীক্ষা নেওয়া- এসবের দিকে কেউ কেউ হয়তো ঝুঁকেছে। তবে সবাই যে এ কাজে যুক্ত ছিল বিষয়টা এমন নয়। আমরা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে অনেককে আটক করেছি। তাদের জঙ্গিবাদের দীক্ষা থেকে ফেরানোর জন্য মানসিকভাবে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। তবে এটা বুঝতে হবে, গুজব কিন্তু স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তৈরি হয় না। ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে যেমন আগাছা বা ফার্ন জন্মে তেমনি গুজবের জন্য একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ লাগে। ঘোলাটে পরিবেশে গুজব সৃষ্টিকারীরা তাদের মনগড়া কাহিনি প্রচার শুরু করে। করোনা পরিস্থিতির কারণেও আমরা অনেক ধরনের গুজব লক্ষ্য করেছি। যেমন গুজব ছড়ানো হচ্ছে- লাখ লাখ মানুষ মরছে, গোপন করা হচ্ছে, লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে এসব। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে, নাগরিক সাংবাদিকতার কারণে কোনো বিষয় গোপন করা কঠিন। এখন সবাই জানে বাংলাদেশে সেভাবে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়নি। যারা এ ধরনের গুজব ছড়িয়েছে তাদের মধ্যে যাদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন তাদের আনা হয়েছে। গুজব রটনাকারীদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করা গেছে।

বা. প্র. : চলমান মহামারীর সময়ে অনেক রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন এমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। কভিড হাসপাতালেও পজিটিভ রিপোর্ট ছাড়া রোগী না নেওয়া এবং নন-কভিড হাসপাতালে নেগেটিভ রিপোর্ট ছাড়া রোগী ভর্তি না নেওয়ার অভিযোগও বিস্তর। অতীতে চিকিৎসা ব্যবস্থার অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে কাজ করলেও বর্তমানে র‌্যাব নিশ্চুপ কেন?

এডিজি : করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরই মৃদু বা মাঝারি উপসর্গ দেখা দেয়। আইসোলেশন সেন্টার বা বাড়িতেই চিকিৎসা হতে পারে। খারাপ পরিস্থিতি হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। আমরা যদি ডাক্তারদের ওপর চাপ কমাতে পারি, সচেতন হই তবে ঢাকার বাইরে থেকে আসা জটিল রোগীরা হাসপাতালে সহজেই জায়গা পাবে। যেসব ক্লিনিক বা হাসপাতাল করোনা বা অন্য রোগীদের চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত চলবে। আমরা অতীতে যেভাবে সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করেছি এখনো সেভাবেই করব। কিন্তু সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের ক্ষেত্রে যেমন সরাসরি গ্রেফতার করে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, দুর্নীতির ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু ভিন্ন। এক্ষেত্রে দলিল-দস্তাবেজ না দেখে তাড়াহুড়া করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মামলা করলে ফাঁকফোকর থেকে যায়। ফলে জামিনে বের হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের নজরদারি অব্যাহত আছে। চিকিৎসা-সংক্রান্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের কার্যক্রমের প্রমাণ আমরা যথাসময়ে দেব।

বা. প্র. : করোনার সময় মাদক ব্যবসা বন্ধ হয়নি। করোনা সবকিছু কোনো না কোনোভাবে স্থবির করলেও মাদক ব্যবসাকে স্থবির করতে পারেনি। ক্ষেত্রবিশেষে বরং বেড়েছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

এডিজি : প্রথমেই বলি, র‌্যাবের মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত আছে। আমরা পরিসংখ্যান যদি দেখি তাহলে দেখব গত বছরের মাদক উদ্ধারের কাছাকাছি আমরা আছি। তবে দাবি করছি না যে, আমরা সব ধরে ফেলেছি। সব মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার হয়েছে। তা হয়নি। তবে আমাদের অভিযান চলছে। গণমাধ্যমের কাছ থেকে, আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দা চ্যানেলে তথ্য সংগ্রহ করে আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি।

বা. প্র. : করোনাকালে ক্যাসিনো কারবারি বা অন্য দুর্নীতিবাজরা তদন্ত থেকে দূরে থাকার সুযোগ পাচ্ছে?

এডিজি : একেবারেই না। যারা করোনা পরিস্থিতির কারণে একটা দায়মুক্তির সুযোগ খুঁজছিলেন তারা ইতিমধ্যে বার্তা পেয়ে গেছেন যে, আমরা ঘরে বসে নেই। ফলে তাদের নিস্তার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া ভেজাল বা নকলের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত ছিল, এখনো থাকবে। ভেজাল ওষুধ বা নকল সুরক্ষা সামগ্রীর বিরুদ্ধে অভিযান আমরা আরও বেগবান করব।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর