বুধবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

শ্রমবাজারে ঘোর অন্ধকার

চাকরি হারিয়ে দেশে ৮৫ হাজার শ্রমিক, আটকে থাকা ৬ লাখ ২৪ হাজার শ্রমিকের মধ্যে কর্মস্থলে ফিরেছে মাত্র ১০ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে অস্থিরতা, আশ্বাসে আটকে আছে মালয়েশিয়া, পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কায় মিশনগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশ, নতুন বাজার খোঁজার টার্গেট

জুলকার নাইন

শ্রমবাজারে ঘোর অন্ধকার

প্রবাসে কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ দাবিতে গতকাল রাজধানীতে মানববন্ধন

বিশ্ব মহামারী করোনা থামিয়ে দিয়েছে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি। কাজ হারিয়ে এরই মধ্যে দেশে ফিরে বেকার সময় পার করছেন লাখো প্রবাসী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দাভাব। দিন দিন শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে আসছে। দীর্ঘ মেয়াদে বৈদেশিক শ্রমবাজারের দরজা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে কিছু শ্রমবাজারে তৈরি হয়েছে বাড়তি সংকট। সব মিলিয়ে শ্রমবাজারের সামনে ঘোর অন্ধকার। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বড় ধসের আশঙ্কা করা করা হচ্ছে। অবশ্য সংকট থেকে বের হতে বিকল্প শ্রমবাজার খুঁজতে শুরু করেছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। পূর্ব এশিয়া বা ইউরোপে অন্তত দুটি বাজার খোঁজার টার্গেট নেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপই সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে গত ১ এপ্রিল থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ মাসে ২৬টি দেশ থেকে ৮৫ হাজার ৭৯০ জন প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরেছেন, যার মধ্যে ৫ হাজার ৬৫৭ জন নারী রয়েছেন। বিদেশফেরতের মধ্যে মোট ২৭ হাজার ৬৫৮ জন ফিরেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আর ১৭ হাজার ৩১৭ জন ফিরেছেন সৌদি আরব থেকে। এর অধিকাংশই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বেকার হয়ে দেশে ফিরেছেন। এর বাইরে গত ২১ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটিতে আসা ৬ লাখ ২৪ হাজার শ্রমিকের বড় অংশ আটকে গেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কিছু করে আটকে পড়া শ্রমিকের একটি অংশ ফিরতে শুরু করেছেন। কিন্তু সে সংখ্যাও বেশি নয়।

জানা যায়, বিশ্বের প্রায় ১৬০টি দেশে শ্রমিক প্রেরণ করে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। এর পরের অবস্থানে ওমান, কাতার, জর্ডান ও কুয়েত। সম্প্রতি সিঙ্গাপুরও বাংলাদেশের জন্য ভালো বাজার হয়ে উঠেছে। তবে করোনার থাবায় জনশক্তি রপ্তানিতে রীতিমতো হোঁচট। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে ৭ লাখের বেশি কর্মী চাকরি নিয়ে গেছেন বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে সৌদি আরবে সর্বোচ্চ ৪ লাখের মতো, ওমানে ৭২ হাজার ও কাতারে গেছেন ৫০ হাজারের কিছু বেশি। চলতি বছরে ১০ লাখ কর্মী পাঠানোর লক্ষ্য থাকলেও প্রথম তিন মাসে পাঠানো সম্ভব হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৮১ হাজার। এর পর থেকেই করোনা মহামারীতে বন্ধ শ্রমিক প্রেরণ। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছেন ১ লাখ ৩৪ হাজার এবং ওমানে ১৭ হাজার। বাকি বাজারগুলোয় গেছেন হাতে গোনা কয়েকজন। সব মিলিয়ে এখন বাংলাদেশের একমাত্র অবলম্বন সৌদি আরবের শ্রমবাজার। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির আগেই সে শ্রমবাজার নিয়েও নানা শঙ্কা দেখা দেয় পরিবর্তিত রাষ্ট্রীয় নীতি ও কর্মক্ষেত্রে অটোমেশনের (স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির ব্যবহার) কারণে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় করোনা মহামারী, তেলের দামে ধস ও দেশে ছুটিতে আসা বিশালসংখ্যক শ্রমিকের আটকে যাওয়া। এখন সৌদি আরবের বাজার বন্ধ হলে জনশক্তি রপ্তানিতে বড় ধস নামার আশঙ্কা জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আশার আলো হয়ে থাকা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আশ্বাসেই আটকে আছে। দুই দফা বৈঠকের পর নতুন পদ্ধতিতে শ্রমিক নিয়োগের তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করে মালয়েশিয়া। দেশটির পক্ষ থেকে নতুন অনলাইন পদ্ধতিতে কর্মী নেওয়ার বিষয়ে আশ্বস্তও করা হয়। এর মধ্যে নতুন সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে করোনা। বর্তমান বাস্তবতার পাশাপাশি নানা অসাধু কর্মকান্ডও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে শ্রমবাজারের ওপর। কুয়েতে এমপি পাপুলের কেলেঙ্কারিতেই বাংলাদেশি শ্রমিক প্রেরণের বিষয়টি পড়েছে হুমকিতে। বিপুল কর্মযজ্ঞ চলা কাতারে একশ্রেণির প্রতারক তৈরি করছে ইমেজ সংকট। ফ্রি ভিসা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে পাড়ি জমানো বড়সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক এমনিতেই বিপাকে। আবার এসব কর্মহীন প্রবাসীকে দিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করিয়ে মজুরি না দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে প্রতারক চক্র। ফ্রি ভিসার শ্রমিকদের কাজের চুক্তিপত্র না থাকায় তেমন কোনো উদ্যোগও নেওয়া যাচ্ছে না কাতারে। গেল কয়েক বছর ধরেই নানামুখী সংকটে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননের শ্রমবাজার। বর্তমানে ১ লাখ নারী শ্রমিকসহ প্রায় ১ লাখ ৬৮ হাজার বাংলাদেশি লেবাননে পড়েছেন মহাবিপাকে। বৈরুত বিস্ফোরণের পর দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থা আরও প্রকট হয়েছে। বন্ধ হতে বসেছে শ্রমবাজার। মাসের পর মাস বেতন না পাওয়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও অর্থের মান কমে যাওয়ায় দেশটিতে থাকার আশা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। কারণ দেশটিতে বাংলাদেশি বেশির ভাগেরই কাজ নেই। যাদেরও বা কাজ রয়েছে তারা এখন অনেক কম পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। দেশে অর্থ পাঠানো দূরের কথা, নিজেই তিন বেলা খেয়ে-পরে থাকতে পারছেন না। এ অবস্থায় দেশে ফেরাকেই একমাত্র সমাধান দেখছেন তারা।

সংকট কাটবে, সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে বলে আশাবাদী প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, ‘দুটি নতুন মার্কেট যদি ধরতে পারি তবে ওই মার্কেটের তো কর্মী নেওয়ার অবস্থা থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত ওই অবস্থা তৈরি হয়নি। যেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন আমরা সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি। সেই সঙ্গে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর লক্ষ্যেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’

আটকে পড়ারা মহাবিপাকে : করোনা মহামারীতে আটকে পড়া প্রবাসীদের ফিরে যাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে। ট্রাভেল এজেন্টরা জানাচ্ছেন, ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ। অনেকের টিকিটের মেয়াদ চলে গেছে। আসছেন রি-শিডিউল করার জন্য। কিন্তু ফ্লাইট চালু না হলে তো টিকিট দেওয়া যাচ্ছে না। এর ওপর করোনা সনদ লাগছে। একটা অ্যাপ্রুভাল লেটার আবার অনলাইনে পাঠাতে হচ্ছে দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে। সেটা ছাড়া অনেকে গিয়েও আবার ফেরত এসেছেন। প্রতিদিনই প্রবাসীরা ট্রাভেল এজেন্টগুলোর অফিসে ধরনা দিচ্ছেন কিন্তু কেউ কোনো আশ্বাস দিতে পারছে না। অন্যদিকে, দেশে আটকে থাকার পর অর্থকষ্টে পড়েছেন প্রবাসীদের বড় একটি অংশ। প্রতিদিন শত শত প্রবাসীর পক্ষ থেকে মানবিক সহায়তার আবেদন পড়ছে জনশক্তির কার্যালয়গুলোয়। সারা দেশে এমন কয়েক হাজার আবেদনে খাদ্যসহায়তার পাশাপাশি আর্থিক অনুদানও চেয়েছেন প্রবাসীরা। অনেকে ঋণ সহায়তার আবেদনও করছেন। কিন্তু কোনোটিতেই এখন পর্যন্ত সেভাবে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট-রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকীর মতে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখা সত্ত্বেও এ পরিস্থিতিতে তাদের পরিবারগুলোকে একটু বেঁচে থাকার জন্য যে সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার দরকার ছিল তা আমরা এখন পর্যন্ত দেখতে পাইনি। তাদের পরিবারগুলোর জন্য এখনো কিছুই করা হয়নি। তবে সরকারের ঋণ প্রকল্পের যে ব্যবস্থাগুলো করা হয়েছে তা ভালো উদ্যোগ।

শঙ্কিত সংসদীয় কমিটির মিশনগুলোকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ : মহামারী করোনার প্রভাবে বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এতে শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই প্রবাসে অবস্থানরত জনশক্তির শ্রমবাজার যেন সংকুচিত না হয় সেজন্য বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনগুলোকে সতর্ক থাকতে বলেছে সংসদীয় কমিটি। কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে এ বিষয়ে মিশনগুলোকে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার সুপারিশ করা হয়েছে। বৈঠকে বিকল্প শ্রমবাজার কম্বোডিয়া, পোল্যান্ড, চীন, রুমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও সিশেলসে কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়। এ ছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে বিভিন্ন দেশে কর্মহীন হয়ে পড়া বাংলাদেশি কর্মীরা করোনা-পরবর্তী সময়ে যেন ফের সে দেশে যেতে পারেন সে বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়।

কর্মস্থলে ফিরতে ও আর্থিক সহায়তার জন্য প্রবাসীদের মানববন্ধন : মালয়েশিয়ায় কর্মস্থলে ফিরে যেতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ছুটিতে আসা প্রবাসীরা। গতকাল এ দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন তারা। প্রবাসীরা জানান, মালয়েশিয়া থেকে কেউ সাত মাস কেউ আট মাস আগে ছুটিতে দেশে এসেছিলেন। তিন-চার মাসের ছুটি শেষে আবার ফিরে যাবেন কর্মস্থলে। কিন্তু ছুটি ও ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও তারা যেতে পারছেন না। করোনাভাইরাসের কারণে মালয়েশিয়ায় বিদেশিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের আর ফেরা হয়নি। কবে উঠবে নিষেধাজ্ঞা, কবে তারা ফিরতে পারবেন তার ঠিক নেই। এ অবস্থায় দেশে ফেরা প্রবাসীরা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। প্রবাসীদের দাবি, তারা মালয়েশিয়ায় দ্রুত কর্মস্থলে ফিরে যেতে সরকারের সহযোগিতা চান। এ ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এ ছাড়া যত দিন তারা মালয়েশিয়ায় ফিরতে না পারবেন তত দিন তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের দাবি তোলা হয়।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর