বর্ষা এলেই ডুবে যায় ঢাকা। বন্ধ খাল, বদ্ধ ড্রেনের কারণে জলাবদ্ধতা তৈরি হলেও সমাধানের পথ খোঁজার বদলে চলে দোষারোপ। দীর্ঘদিনের জনভোগান্তি নিরসনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ওয়াসার হাতে থাকা খালের দায়িত্ব চাইলেও এখনই মিলছে না ক্ষমতা। ৫৬ সেবা সংস্থার সমন্বয়হীনতা কাটিয়ে এক ছাতার নিচে সেবা নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো তাজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজধানীর সেবা সংস্থাগুলো এক ছাতার নিচেই আছে। সিটি মেয়ররা খালের সংস্কারসহ রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে চান। তাদের সক্ষমতা হলে দায়িত্ব হস্তান্তর করা যাবে, তাতে আমি নিজেও উৎসাহবোধ করি। অফিশিয়াল নির্দেশনা জারি তো ১০ মিনিটের ব্যাপার। কিন্তু সিটি করপোরেশন তো আর ১০ মিনিটে সক্ষমতা তৈরি করতে পারবে না। তাদের এ কাজ করতে হলে দক্ষ জনবল থাকতে হবে। প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। যেসব যন্ত্রপাতি দরকার, তা থাকতে হবে।’
স্থপতি ও নগরবিদ ইকবাল হাবিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা একটি কেন্দ্রীয় অভিভাবক চাই। যেই কেন্দ্রীয় অভিভাবক ঢাকা শহরের নগর দর্শনের দায়িত্বে থাকবেন। সেই দায়িত্ব অনুযায়ী নগরনীতি, পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন ও নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীয় অভিভাবক হিসেবে কাজ করবেন। আর সেবা সংস্থাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে হোক বা সংঘবদ্ধভাবে হোক সেসব পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হবেন। এই অভিভাবক হিসেবে তা নিশ্চিত করবেন। এক্ষেত্রে আমরা সিটি করপোরেশনকে অভিভাবকের যোগ্য মনে করি। কারণ, তারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। এক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিতা, সাম্যতা ও অর্থনৈতিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাকে প্রাধান্য দিতে হবে।’
খাল বণ্টনের সুরাহা হয়নি : ঢাকায় ৪৭টি খালের মধ্যে ২৬টি টিকে আছে। বাকিগুলো দখলের কবলে। বেঁচে থাকা খালগুলোর অবস্থাও সঙ্গিন। সরু নালায় পরিণত হয়েছে খালগুলো। পানির ধারা ২০-৪০ ফুটে কোথাও কোথাও বন্ধ হয়ে গেছে গতিপথ। খালকে বক্সকালভার্টে ঢুকিয়ে তৈরি হয়েছে রাস্তা। এখন সেই কালভার্টে বর্জ্য জমে বন্ধ হয়ে গেছে পানি যাওয়া-আসার পথ। এভাবে মৃতপ্রায় খালগুলোতে গিয়ে পড়ে রাজধানীর সব ড্রেনের পানি। বৃষ্টি বেশি হলে বাধে বিপত্তি। খালে প্রবাহ স্বাভাবিক না থাকায় দ্রুত নামতে পারে না বৃষ্টির পানি। এতে করে রাজধানীজুড়ে তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সূত্রে জানা যায়, আশকোনা ও কালসির খাল ভরাট হলেও তা পরিষ্কার করেনি ওয়াসা। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই ওই সব এলাকা ও আশপাশে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো। কোমর পর্যন্ত পানি জমে যেত রাস্তায়। এ রাস্তায় চলাচলে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হতো জনসাধারণকে। ডিএনসিসি নিজস্ব অর্থে খাল দুটি পরিষ্কার করেছে। এখন আর ওই সব এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় না। গত ২৭ জুন আশকোনা হজক্যাম্প থেকে সিভিল এভিয়েশন অফিসার্স কোয়ার্টার হয়ে বনরূপা হাউজিং পর্যন্ত খননকৃত খালের উদ্বোধন করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ও ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। এ সময় মেয়র আতিকুল ইসলাম মন্ত্রীর কাছে ঢাকা উত্তরের সব খাল ও ড্রেন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেলের বিদ্যমান জনবল, ভৌত অবকাঠামো, আনুষঙ্গিক সব উপকরণসহ ডিএনসিসির কাছে হস্তান্তরের প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাবের ব্যাপারে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা উত্তরে মোট ১৭টি খাল আছে। তার মধ্যে ডিএনসিসিতে সংযুক্ত নতুন ১৮টি ওয়ার্ডেই ১৩টি খাল। ২০০৯ সাল থেকে খালগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। জনগণের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা আছে। খাল থাকবে অন্যদের দখলে, আর গালি শুনব আমরা- এটা হতে পারে না। তাই আমরা মন্ত্রণালয়ে বলেছি, খালগুলো যন্ত্রপাতি ও জনবলসহ আমাদের দিয়ে দিতে। কাজের ক্ষেত্রে আমরা তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারব।’ তিনি আরও বলেন, ‘নতুন ওয়ার্ড আধুনিকায়নে একনেকে প্রকল্প পাস হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় নতুন ওয়ার্ডের ১৩টি খাল সংস্কার আমরা করব। বাকিগুলোর দায়িত্ব আমরা চেয়েছি। অবকাঠামো-জনবলসহ দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলে আমরা খাল সচল করে দেব।’
গত ২২ জুলাই জলাবদ্ধতার অবস্থা দেখতে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছেন ঢাকার দুই সিটির মেয়র। সেখানে দুই মেয়র প্রকাশ্যেই ওয়াসাসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার গাফিলতির চিত্র তুলে ধরছেন। ওয়াসার খালের দায়িত্ব তারা নিজেরা চেয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ‘ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ওয়াসা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)। কিন্তু তারা এটি করতে ব্যর্থ হয়েছে।’ ঢাকা ওয়াসাও চায় না খালগুলো তাদের নিজেদের কাছে রাখতে। সংস্থাটির মতে, এটি তাদের জন্য বাড়তি বোঝা। ২০১২ সাল থেকেই খালগুলো সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে আসছে সংস্থাটি। এ নিয়ে অনেক কমিটি ও সভা হলেও কার্যত সঠিক কোনো সিদ্ধান্ত পাননি তারা।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এক সময় সিটি করপোরেশন এ কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। পরে তার দায়িত্ব ওয়াসাকে দেওয়া হয়। খালগুলো ওয়াসা, পূর্ত মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে আছে। এসব সংস্থার সঙ্গে আমি সম্মিলিতভাবে বৈঠক করছি। খালগুলো নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা করা হচ্ছে। তারা সর্বাঙ্গীন অর্জন করেছে এটা মনে করি না। তবে অন্যবার যখন বৃষ্টি হতো রাজধানীতে হাঁটুপানি হতো। সেই পানি নামতে এক-দুই দিন সময় লাগত। এ বছর অতিমাত্রায় বৃষ্টি হয়েছে। সেই পানি অর্ধদিনের মধ্যেই প্রায় নেমে গেছে। ভালো-মন্দ যাই করুক, খালগুলো নিয়ে তিনটি সংস্থা দায়িত্ব পালন করেছে। তাদের সক্ষমতাও গড়ে উঠেছে।’
ড্রেনেজ নিয়ে টানাপড়েন : রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থার বিভিন্ন অংশ ওয়াসা, রাজউক, ডিএনসিসি, ডিএসসিসি, ঢাকা জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিসি দেখভাল করে। এতে সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হয়। সমস্যা হলে চলে দোষারোপ, ভোগান্তি পোহায় জনগণ। ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই ডিএনসিসির সমন্বয় সভায় তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন রাজধানীর জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা সিটি করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সভায় ডিএনসিসির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থা আমাদের বিকলাঙ্গ সন্তান। তাকে সুস্থ করে চলার উপযোগী করে আমাদের হাতে দিন। তার পরই কেবল দায়িত্ব নিতে পারব।’ মাঝের দুই বছরে পরিবর্তন এসেছে দুই পদেই শুধু অপরিবর্তিত রয়েছে ওয়াসা ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা। ময়লা জমতে জমতে কঠিন বর্জ্যে পরিণত হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে পানি প্রবেশের মুখ। বেশি বৃষ্টি হলেই পানির চাপ নিতে পারে না জীর্ণ এসব ড্রেন। ফলে পানিতে ভেসে যায় রাজধানীতে তৈরি হয় জলজট। ৫৬ সেবার সংস্থার সমন্বয়হীনতায় কমে না রাজধানীবাসীর ভোগান্তি।
নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজধানীর সেবা সংস্থাগুলো নিয়ে বহুদিন ধরে কথাবার্তা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত উপসংহারে আসে, সম্মিলিতভাবে পরিচালনা দরকার। একটি কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকলেই ভালো হয়। সেক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনকেই দায়িত্ব দেওয়া দরকার। কারণ, ওয়াসার যে সেবা পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, তা এক সময় পৌরসভার অধীনেই ছিল। তারপর ১৯৬৩-৬৪ সালে যখন ওয়াসা তৈরি হয়, তখন পানির জন্য আলাদা সংস্থা করা হয়। ওয়াসার সেবা নিয়ে আগে মানুষ সন্তুষ্ট থাকলেও এখন তা নয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই বলা হচ্ছে, সমন্বয় করা হোক। এক্ষেত্রে দুই সিটি মেয়রের নেতৃত্বে একটি সমন্বয় কর্তৃপক্ষ বানানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের অন্যসব ব্যবস্থাগুলোও লাগবে। সরকারের দৃঢ় সমর্থন ও সহযোগিতাও লাগবে। তারা হয়তো নেতৃত্বটা দিতে পারবেন, সেটাকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে। তবে বিষয়টি অনেক জটিল।