পাশের দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কুয়েত, তাইওয়ান ভিয়েতনামের কোনো ইকোনমিক জোনে বিনিয়োগ করলে উদ্যোক্তারা অতিরিক্ত কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। যা ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশে সহায়ক হিসেবে কাজ করে বলে মনে করে সেসব দেশের সরকার। এসব সুযোগ-সুুবিধার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ট্যাক্সহলিডে, ভ্যাট ও কর ছাড়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের পরিষেবার ক্ষেত্রে কর ও ভ্যাট ছাড় দিয়ে থাকে এসব দেশ। অথচ বাংলাদেশে ঘটছে এর ঠিক উল্টোটা। এখানকার ইকোনমিক জোনে বিনিয়োগ করতে গেলে বিনিয়োগকারীদের জমি ইজারার ওপর অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এসব অঞ্চলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইউটিলিটি সার্ভিসের ওপরও অতিরিক্ত দশমিক ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ আরোপ করা হয়েছে। যা জমি ইজারা সংক্রান্ত মূল চুক্তিবহির্ভূত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য খুবই হতাশাজনক। যা মূলত বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, যে কোনো সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতা তো রয়েছেই। একমুখী সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই। উদ্যোক্তারা মনে করেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে। যা সার্বিকভাবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে উদ্যোক্তারা ইকোনমিক জোনে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে দেশি-বিদেশি কোনো বিনিয়োগই নতুন করে আসবে না। বরং ইতিপূর্বে স্থাপিত শিল্প-কারখানাগুলোও সরিয়ে নেওয়ার চিন্তা করবেন উদ্যোক্তারা।
এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য হতাশা ডেকে আনবে। এমনিতেই করোনার অচলাবস্থার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে খুবই নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিনিয়োগ ধরে রাখতে পৃথিবীর অন্য সব দেশই নানা ধরনের ছাড় দিচ্ছে উদ্যোক্তাদের জন্য। অথচ আমাদের এখানে সুবিধা না দিয়ে উল্টো অতিরিক্ত চার্জ আরোপ করা হচ্ছে। যা ব্যবসা-বিনিয়োগের জন্য মোটেও সহায়ক নয়। সূত্র জানায়, জমি ইজারার ওপর অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটির (বেজা) বোর্ড সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি এখনো এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। এরই মধ্যে আবার ইউটিলিটি সার্ভিসের ওপর অতিরিক্ত দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত চার্জ আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব জোনে বিনিয়োগকারীদের তা জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। এতে উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। একদিকে করোনাযুদ্ধের সঙ্গে টিকে থেকে ব্যবসার পুঁজি রক্ষা করাই যেখানে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে আবার নতুন করে ভ্যাট ও করের বোঝা চাপছে উদ্যোক্তাদের ঘাড়ে। যা বিনিয়োগকারীদের মাঝে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে নীতি জটিলতা, অবকাঠামো সংকট আর বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব প্রকট। এজন্যই আমরা বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ হারাচ্ছি। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে এখানে বিনিয়োগ করতে বা ব্যবসা করতে এলে কী ধরনের জটিলতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হতে পারে সে সম্পর্কেও পরিষ্কার জানেন না বিদেশিরা। কী ধরনের জটিলতায় পড়তে হবে এটা জানতে পারলে তাদের একটা প্রস্তুতি থাকত। কিন্তু আমরা তো সেটা পরিষ্কার করতে পারি না। আর আছে নীতির অনিশ্চয়তা। ফলে এটা বিদেশি বিনিয়োগের জন্য একটা মারাত্মক হুমকি। এখন আবার জমি ইজারার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ইউটিলিটির ওপর অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ আরোপ করা হয়েছে বলে শুনেছি। এভাবে আসলে বিনিয়োগ ধরা যাবে না। বিনিয়োগ ধরতে হলে পলিসিগুলো সহজ করতে হবে। ভ্যাট-করসহ নানাভাবে কিছু সুযোগ-সুবিধাও দিতে হবে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটির (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, জমি ইজারার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত যে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে এবং ইউটিলিটির ওপর অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ আরোপ করা হয়েছে তা বিনিয়োগের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। বিনিয়োগের সুবিধার্থে কর ও ভ্যাটনীতি আরও সহজ করা দরকার এটাও আগে থেকেই বলে আসছি। এ ছাড়া জমি বরাদ্দের ব্যাপারে যত রকম জটিলতা রয়েছে সেগুলো দূর করার চেষ্টা করছে বেজা। এজন্যই সারা দেশে ১০০টি ইকোনমিক জোন তৈরি করা হচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করা হয়েছে। আশা করি শিগগিরই একটা চমৎকার সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, আমি মনে করি জমি ইজারার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করায় বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। এতে তাদের আস্থা ও আত্মবিশ্বাসটা নষ্ট হয়ে যাবে। যা এই মুহূর্তে করা ঠিক হবে না বলে তিনি মনে করেন। কেননা কভিড-১৯ এর মহামারীর কারণে এমনিতেই সবাই বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। অনেক বিনিয়োগকারীই পুঁজির সংকটে রয়েছে। এর মধ্যেই যদি এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় তা বিনিয়োগের জন্য মোটেও সুখকর হবে না।