শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারে খবর নেই

চুরির পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে, আশ্বাসও নেই ৫৬১ কোটি টাকা ফেরতের

জুলকার নাইন ও আলী রিয়াজ

রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারে খবর নেই

বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চুরির পাঁচ বছর পেরিয়ে গেল। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা সারা বিশ্বে আলোড়ন তুললেও চুরি হওয়া টাকা এখনো উদ্ধার হয়নি। চুরি হওয়া ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ৫৬১ কোটি টাকা এখনো ফেরত পায়নি বাংলাদেশ। নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ বা নিউইয়র্ক ফেডে রক্ষিত এ অর্থ চুরি যাওয়ার পর টাকা স্বাভাবিকভাবেই ফেরত পাওয়া যাবে বলা হলেও তা আর হয়নি। নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ বা ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংক কেউ কোনো দায় নিতে রাজি নয়। মার্কিন কোর্টে বাংলাদেশের করা মামলাও টেকেনি। এখন নিউইয়র্কের ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের মামলার রিভিউর ওপর ভরসা করা হলেও অর্থ ফেরত পাওয়ার তেমন কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না।

জানা যায়, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়। অজ্ঞাত ব্যক্তিরা সুইফট পেমেন্ট পদ্ধতিতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (ফেড) রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ওই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়। এ অর্থ ফিলিপিন্সের মাকাতি শহরে রিজাল ব্যাংকের শাখায় চারটি ভুয়া অ্যাকাউন্টে যায় এবং সেখান থেকে দ্রুত অর্থ উত্তোলন করা হয়। পরে বিভিন্ন সময় ফেরত আসে ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এখনো রয়ে গেছে ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ৫৬১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মো. রাজি হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা নিউইয়র্কের স্টেট কোর্টে মামলা করেছি। মামলার পর কোর্ট রিভিউ করেছে এবং সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তদের সমন পাঠিয়েছে। ক্রস বর্ডার হওয়ায় এ সমনের ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লেগেছে। এখন শুনানির অপেক্ষায়। শুনানির তারিখ নির্দিষ্ট হয়নি। সিভিল মামলা হওয়ায় বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। করোনা পরিস্থিতির কারণেও দীর্ঘায়িত হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের মামলা করতেও কিছুটা দেরি হয়েছিল। এখন সবকিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে এসেছে। আশা করি দ্রুত একটি রায় পাব এবং টাকা ফেরত আনতে পারব।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত বড় চুরির ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশ তেমন কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। বাংলাদেশের কেউ রিজার্ভ চুরির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল কিনা, কিংবা কারও দায়িত্বহীনতা বা অবহেলায় চুরি হয়েছে কিনা তাও জানা যায়নি। শুধু অর্থ চুরি যাওয়ার বিষয়টি প্রায় এক মাস গোপন করে রাখায় পদত্যাগ করতে হয় তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানকে। সরিয়ে দেওয়া হয় দুই ডেপুটি গভর্নরকেও। এ ছাড়া কারও কোনো শাস্তিও হয়নি। সবাই আছেন বহাল তবিয়তে। কেউ কেউ পদোন্নতিও পেয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের করা মামলা তদন্তের মধ্যেই আছে সিআইডি। তবে সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের অরক্ষিত নিরাপত্তাব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার কথা উঠে এসেছে।

সূত্র জানান, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক শেখ রিয়াজউদ্দিনের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে রাত ৮টা ৩৬ মিনিট থেকে ভোররাত ৩টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত সময়ে নিউইয়র্ক ফেডকে ৩৫টি মেসেজ পাঠিয়ে ৯৫ কোটি ১০ লাখ ৬ হাজার ৮৮৬ ডলার স্থানান্তরের আদেশ যায়। এর মধ্যে মিশেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার এম ল্যাগোস, আলফ্রেড সান্তোস-ভেরগারা, এনরিকো টেওডোরা ভাসকয়েজ এবং রালফ ক্যাম্পো পিকাচির নামে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনে (আরসিবিসি) খোলা ব্যাংক হিসাবে ৮ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬২৩ ডলার এবং শ্রীলঙ্কার শালিখা ফাউন্ডেশনের নামে আরও ২ কোটি ডলার স্থানান্তরের আদেশ দেওয়া হয়। ইংরেজি ‘ফাউন্ডেশন’ বানানে ‘ও’ অক্ষরটি ছিল না। এ ভুল বানানের কারণে শালিখা ফাউন্ডেশনের নামে পাঠানো অর্থ স্থানান্তর হওয়ার আগেই আটকে যায়, যা পরে ফেরত আসে। কিন্তু ফিলিপাইনে পাঠানো চারটি হিসাবে অর্থ স্থানান্তর হয়ে যায়। ফিলিপাইনে রালফ ক্যাম্পো পিকাচির হিসাবেও অর্থ স্থানান্তর হয়নি। অর্থাৎ ৩৫টি বার্তার মধ্যে শেষ পর্যন্ত চারটি কার্যকর হয়, একটির বানান ভুলের কারণে ফেরত আসে, আর বাকি ৩০টি বার্তার ক্ষেত্রে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সন্দেহ হলে তা স্থানান্তর না করে বাংলাদেশকে ফিরতি মেসেজ পাঠায়। কিন্তু নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের ফিরতি মেসেজ বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে পারে দুই দিন পর। আর পাঁচ দিন পর ৯ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের ব্যাংক হিসাব থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় টাকা।

তথ্য দিচ্ছে না কোনো দেশ : বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ২০১৬ সালে মার্চে মানি লন্ডারিং আইনে যে মামলা হয়েছিল তার তদন্ত করতে দিয়ে কোনো দেশের পক্ষ থেকে তথ্য পাচ্ছে না পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দেশের ভিতরের লোকজন ছাড়াও বাইরের কয়েকটি দেশের ৩০ জনের বেশি দুর্বৃত্তকে শনাক্ত করেছে সিআইডি। এসব ব্যক্তির তথ্য পেতে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে চিঠি চালাচালি হচ্ছে। তবে ফিলিপাইন ছাড়া আর কোনো দেশ এখনো এসব অপরাধীর তথ্য সরবরাহ করেনি। ফিলিপাইন ছাড়াও হংকং, ম্যাকাও, চীন, শ্রীলঙ্কা, মিসর, সিঙ্গাপুর ও জাপানের অপরাধীরা জড়িত এ রিজার্ভ চুরির সঙ্গে। এসব বিদেশি অপরাধীর তথ্য না পাওয়ায় তদন্তের সমাপ্তি টানতে পারছে না সিআইডি। আদালতে ইতিমধ্যে ৪৬ বার পিছিয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময়। আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদালতের তারিখ নির্ধারিত আছে।

ফিলিপাইনের আদালতে ১২ মামলা : দীর্ঘদিনের স্থবিরতার পর বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনকে হাজির হওয়ার নোটিস দিয়েছে ফিলিপাইনের মাকাতির বিচার আদালত। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাগুলোর খবররে এ নোটিসের কথা জানা গেলেও ঠিক কোন মামলায় এ নোটিস তা জানতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ ফিলিপাইনে এ-সংক্রান্ত অন্তত ১২টি মামলা হয়েছিল এবং কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কারাদন্ডসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল। এ ঘটনায় সম্পৃক্ততার দায় প্রমাণিত হওয়ায় ম্যানিলাভিত্তিক রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মাইয়া দিগুইতোকে কারাদন্ড ও জরিমানা করে ফিলিপিন্সের আঞ্চলিক আদালত। এ অবৈধ অর্থ পাচার প্রতিরোধে ব্যর্থতার কারণে ২০১৬ সালের আগস্টেই আরসিবিসিকে রেকর্ড পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি পেসো অর্থাৎ ১ কোটি ৯১ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার জরিমানা করে ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আরসিবিসির সাবেক কোষাধ্যক্ষ এবং যে শাখাটি থেকে অর্থ উত্তোলন করা হয়েছিল সেখানকার পাঁচজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়েছিল। এ ছাড়া সেখানকার আইন বিভাগ আরও ১০টি মামলা নিজেদের উদ্যোগে চালাচ্ছে। বাংলাদেশ মূলত মামলা করে নিউইয়র্কের ম্যানহাটান ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছিল, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক আরসিবিসি, সোলায়ার রিসোর্ট ও ক্যাসিনো, মাইডাস রিসোর্ট ও ক্যাসিনো এবং অন্যদের বিরুদ্ধে করা মামলার বিপরীতে বিবাদীদের করা আবেদন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট খারিজ করেছে।’

সর্বশেষ খবর