শনিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

জাতিসত্তা শনাক্ত করার মূল শক্তি ভাষা

মুহম্মদ নূরুল হুদা

জাতিসত্তা শনাক্ত করার মূল শক্তি ভাষা

ইতিহাসপূর্ব কাল থেকে ব্যক্তি ও সামষ্টিক পর্যায়ে মানববিবর্তন অব্যাহত আছে এই গাঙ্গেয় অববাহিকায়, যা বঙ্গীয় ব-দ্বীপ নামে পরিচিত। সেই সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে মানুষের অভিব্যক্তিও। সেই অভিব্যক্তির মুখ্য উপকরণ তার ভাষা। আমাদের ক্ষেত্রে এই ভাষার প্রমিত নাম এখন বাংলা। গোত্রীয় অভিব্যক্তি থেকে এই ভাষা এখন বাঙালির জাতীয় ভাষা। আসলে এই ভাষার নানামাত্রিক ব্যবহার শুরু হয়েছে চর্যাপদের কাল থেকে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পর এই ভাষার পরিকল্পিত ও সচেতন ব্যবহারে তার ব্যাপকতা ও গুরুত্ব সুবিস্তৃত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন না হলে বাংলা ভাষার আজকে যে মর্যাদা, সারা পৃথিবীতে তার যে অবস্থান, তা কিছুতেই হতো না। তাই ভাষা চেতনাই যে আমাদের অস্তিত্বের মূল শক্তি- এই বিষয়টা বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পর পরই আমরা উপলব্ধি করেছি। পাশাপাশি এও উপলব্ধি করলাম যে, এই উপমহাদেশে যতগুলো ছোট জাতিসত্তাসম্পন্ন মানবগোষ্ঠী ছিল তার মধ্যে বাঙালিও একটি। এই জাতিগোষ্ঠীর জাতীয়তার বন্ধন শক্তও হয়েছে ভাষার মাধ্যমে। অর্থাৎ, ভাষাই জাতিসত্তাকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় শক্তি এবং নিয়ামক হয়ে আবির্ভূত হয়েছে।

আজ সারা পৃথিবীতে মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন শুরু হয়েছে। আট হাজার মাতৃভাষা ছিল বলে মনে করা হয়। তার মধ্যে চার হাজারই নেই। যেগুলো নেই সেগুলোকে ফিরে পাওয়া এবং যেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে সেগুলোকে রক্ষা করা- এই যে নতুন একটা চেতনা মানুষের মধ্যে এলো এটাই বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় শক্তি, বড় সম্প্রসারণ। কারণ, ভাষা আন্দোলনটা আমরাই শুরু করেছিলাম।

বাংলা ভাষা যখন শুরু হয়েছিল তখনকার বাংলা ভাষা আর এখনকার বাংলাদেশের যে বাংলা ভাষা সেটা অনেকটা আলাদা। বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় আঞ্চলিক ভাষার যে শক্তি, সেটা আমরা ভাষা আন্দোলনের পরপরই শনাক্ত করি। ভাষা যে সংস্কৃতির উৎস হতে পারে সেটাও এখান থেকে দেখলাম। বাংলা ভাষার উন্নতি হয়েছে, সংস্কার হয়েছে। এখন বাংলা বানানে ‘বাড়ি’ লিখি। আগে লেখা হতো ‘বাড়ী’। ভাষাকে আরও সহজবোধ্য করে মানুষের কাছে নিয়ে যেতেই এ সংস্কার। তবে বাংলা ভাষা সর্বস্তরে চালুর যে চেষ্টা ছিল তা অনেকটা পিছিয়ে আছে। এর অন্যতম কারণ- বাংলা ভাষা এখনো দেশীয় স্তর পার হয়ে আন্তর্জাতিক সংযোগের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনো আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে ইংরেজি একটি বড় ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া আমাদের মানসিকতায়ও কিছুটা সমস্যা আছে। এখনো আমরা ইংরেজি বলতে বা লিখতে পারলে অনেক এগিয়ে আছি বলে মনে করি। অফিসে-আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলিত হচ্ছে বটে, কিন্তু বিশুদ্ধভাবে বাংলা ভাষার প্রয়োগ হচ্ছে না।

বিশুদ্ধ বাংলা ভাষার প্রচলন করতে চর্চার দরকার। এজন্য আমি বলব আমাদের লেখকরা বাংলা ভাষাকে যেন মনে-প্রাণে এবং সচেতনভাবে গ্রহণ করেন। লিখিত অবস্থায় বাংলা ভাষার চর্চা করতে হলে বাংলা ভাষার বিবর্তনও পাঠ করতে হবে। এককথায় পড়তে হবে। তরুণদের মধ্যে পাঠের বিষয়টা কমে গেছে, দেখার বিষয়টা বেড়ে গেছে। সবকিছু এখন মিডিয়াভিত্তিক। এখন ডিজিটাল ডিভাইসে সবকিছু রেকর্ড থেকে যাচ্ছে। তবুও বলব সংরক্ষণের জন্য লিখিত টেক্সটের তুলনা নেই। তরুণদের বাংলা ভাষাটা শিখতে হবে। কবিতা লিখতে হলে এর প্রকরণ, ছন্দ- সব কলা-কৌশল শিখতে হবে। এরপর সেই ছন্দকে মানতে না চাইলে না মানুক। একটা টেবিল ভাঙার পর বানানো না জানলে তা ভাঙার অধিকার আমার নেই। নতুন শব্দ আমি প্রয়োগ করতে পারব। কিন্তু পুরনো শব্দটি আমাকে জানতে হবে। তরুণদের জন্য পরামর্শ- আগে পড়ুন, পরে নিজের মতো করে লিখুন। কিছু না পড়ে নিজের মতো করে লিখতে গেলেই মনে হবে আমার আগে পৃথিবীতে কোনো মানুষ ছিল না। আমার আগে রবীন্দ্রনাথ কী নেই, শামসুর রাহমান কী নেই? তাদের বাদ দিয়ে আমার কিছু হওয়া অসম্ভব। মানুষের যাত্রা কখনো একক নয়, সামষ্টিক। লেখা শুরু করা মনের ব্যাপার, কিন্তু লেখা একটা শ্রমেরও ব্যাপার। তাই লেখার আগে পড়তে হবে, জানতে হবে। লেখার সঙ্গে সঙ্গে সচেতনভাবেই আবার আপনাকে সম্পাদনা করতে হবে। এখন সবকিছু ডিজিটাল ভার্সন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, বইয়ের বিকল্প নেই। এটা জ্ঞানের মূর্ত রূপ। সেই মূর্ত রূপে যা লেখা থাকে সেটাই সত্যিকার অর্থে সংরক্ষণ ও বিবর্তনযোগ্য। বইয়ে টেক্সগুলোকে অনন্তকাল ধরে রাখা যায়। ইন্টারনেটে ব্যাকআপ না থাকলে হারিয়ে যায়। তাই আগে গ্রন্থ, পরে তার ডিজিটাল ভার্সন।

লেখক : কবি। অনুলেখক : শামীম আহমেদ

সর্বশেষ খবর