বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বুড়িগঙ্গার বিষ মিশছে পদ্মা-মেঘনায়

বিষাক্ত পানি ছড়িয়ে পড়ছে পাঁচ নদীতে, নৌযানগুলোতে নেই মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা

মানিক মুনতাসির

বুড়িগঙ্গার বিষ মিশছে পদ্মা-মেঘনায়

দুই তীরে গড়ে ওঠা কলকারখানার বর্জ্য যুগ যুগ ধরে বুড়িগঙ্গায় ফেলায় বিষাক্ত পানি -আবু তাহের খোকন

বুড়িগঙ্গার দূষণ এখন আর বুড়িগঙ্গাতেই থেমে নেই। মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়া বুড়িগঙ্গা নদীর পানি ছড়িয়ে পড়ছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, আড়িয়াল খাঁ, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যায়। আবার বর্ষাকালে এই দূষিত পানি বিভিন্ন নদী হয়ে গিয়ে পড়ছে বঙ্গোপসাগরে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, অদূর ভবিষ্যতে অন্য নদীর পানিও বুড়িগঙ্গার মতোই ভয়াবহ দূষণের কবলে পড়বে। বুড়িগঙ্গার দুই তীরে গড়ে ওঠা সব কল-কারখানার বর্জ্য যুগ যুগ ধরে ফেলা হচ্ছে নদীতে। সদরঘাটের দূষণ এখন আর বুড়িগঙ্গায় সীমাবদ্ধ নেই। আবর্জনার সঙ্গে প্রচ- দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চাঁদপুর অঞ্চলের পদ্মা এবং মেঘনার মোহনায়ও। এ ছাড়া সদরঘাট থেকে নদীপথে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা ঘুরে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার দূষিত পানি ছড়িয়ে পড়ছে পদ্মা ও মেঘনার মতো দেশের বৃহৎ নদী ছাড়াও আড়িয়াল খাঁ, গোমতী, ধলেশ্বরী আর শীতলক্ষ্যার বিভিন্ন প্রান্তে। এদিকে দখল আর দূষণের ফলে তুরাগ এখন একটি মরা নদ। বাঁচার জন্য যুদ্ধ করছে বুড়িগঙ্গাও।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সদরঘাটের দূষণ এখন আর বুড়িগঙ্গায় সীমাবদ্ধ নেই। আবর্জনার সঙ্গে প্রচ- দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চাঁদপুর অঞ্চলের পদ্মা এবং মেঘনার মোহনায়ও। আবার এই দূষিত পানি গিয়ে পড়ছে অন্য নদীগুলোতে। বর্ষাকালে স্রোতের তোড়ে বুড়িগঙ্গার এই দূষিত পানি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে বর্ষাকালে বুড়িগঙ্গাসহ অন্য নদীগুলোর পানিতে দূষণ কিছুটা কম পরিলক্ষিত হয়। তবে বছরের বেশির ভাগ সময়ই প্রচ- দুর্গন্ধে নাক, মুখ চেপে লঞ্চে ওঠানামা করতে হয় যাত্রীদের। আবার এই যাত্রীরাও হরহামেশাই নদীতে ময়লা ফেলেন। গত কয়েক বছরে ঢাকা-বরিশাল, ভোলা রুটে অসংখ্য বিলাসবহুল নৌযানের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। যেগুলোর মধ্যে ফুডকোর্ট, লিফট, এসি, টিভি, ফ্রিজসহ অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ন্যূনতম কোনো সুবিধা নেই। এমনকি পয়ঃবর্জ্যও ফেলা হচ্ছে সরাসরি নদীতে। অথচ ভারত, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কার মতো দেশে নদীতে চলাচলকারী যানগুলোতে মানব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর কোনো বালাই নেই। এতে নদীর পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। অবশ্য নৌ-আইন অনুযায়ী লঞ্চে যাতায়াতকারীদের পয়ঃবর্জ্য রিজার্ভ ট্যাংকে সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট ডাম্পিং স্টেশনে ফেলার নিয়ম রয়েছে। যেটি বাস্তবায়নে পরিবেশ অধিদফতর ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকলেও তারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. দিদার-উল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভিয়েতনামসহ অনেক উন্নয়ন দেশেই নৌযানের বর্জ্য ব্যবস্থায় চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে। তারা মানব বর্জ্যগুলোকে সঠিকভাবে ট্রিটমেন্ট করে নির্দিষ্ট স্থানে সরিয়ে নেয়। যেমন ব্যবস্থা রয়েছে বিমানের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের বিমানের ক্ষেত্রে সে ব্যবস্থা থাকলেও নৌযানের ক্ষেত্রে তা আমরা করতে পারিনি। এটা আমাদের পরিবেশ এবং পানির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যা মানব শরীরের জন্যই হুমকি। কেননা মানুষের শরীরে যেসব রোগ বাসা বাঁধে তার বেশির ভাগই ছড়ায় পানির মাধ্যমে। এখানে এ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে যাত্রী, সরকার, লঞ্চ মালিক সমিতি, বিআইডব্লিউটিএসহ সব পক্ষেরই সচেতন হওয়া জরুরি। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে আমাদের অন্য নদীগুলোও বুুড়িগঙ্গার মতোই বিষাক্ত হয়ে যাবে।’

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভয়াবহ এই দূষণ রোধ করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে এসব নদীর পানিও বিষাক্ত হতে হতে একটা সময় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যাবে। খোদ সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বলছে, নদীপথে সদরঘাট থেকে শুধু বরিশাল অঞ্চলে প্রতিদিন দুই সহস্রাধিক নিবন্ধিত যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল করছে। এসব যানে প্রতিদিন প্রায় ৫ লাখ মানুষ যাতায়াত করে। এদের ত্যাগ করা কমপক্ষে ৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য প্রতিদিন বুড়িগঙ্গাসহ এসব নদীতে সরাসরি ফেলা হচ্ছে। দেশে নিবন্ধিত আরও ২০ হাজার ৮০০ মালবাহী নৌযানেরও একই অবস্থা। ময়লা সংরক্ষণ বা ডিসপোজ করার ব্যবস্থা না থাকায় সব ধরনের ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নদীতে। এতে নদীর পানি হয়ে উঠছে ব্যবহারের অনুপযোগী। আর বুড়িগঙ্গার পানি ইতিমধ্যে এতটাই বিষাক্ত হয়েছে যে- মাছ, পোকা-মাকড়সহ কোনো প্রাণীই এ পানিতে বেঁচে থাকতে পারছে না। প্রচ- দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে নাকে-মুখে রুমাল চেপে সদরঘাট ছাড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। এমনকি হঠাৎ করে কোনো মানুষের গায়ে এই পানি লাগলে শরীর প্রচ- চুলকায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মারাত্মক চর্মরোগ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, বুড়িগঙ্গার সঙ্গে যাদের প্রতিদিনের উঠাবসা তাদের পেটের পীড়া, খোস-পাঁচড়াসহ বিভিন্ন রকমের চর্মরোগে ভোগার তথ্য পেয়েছে আইসিডিডিআরবি। সরেজমিন দেখা গেছে, শুধু মানব বর্জ্যই নয়, শিল্প-কারখানা বর্জ্য, নগরীর বর্জ্য, দোকানপাটের ময়লা-আবর্জনা এবং নৌযানের সব ধরনের ময়লা-আবর্জনা নির্বিচারে ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গাসহ সংশ্লিষ্ট নদীগুলোতে। সদরঘাট থেকে চলাচলকারী বড় বড় লঞ্চের ভিতরে ময়লা ফেলার বিন রয়েছে। লঞ্চের যাত্রীদের অনেকেই এসব বিনে ময়লা ফেলছেনও। কিন্তু দিন শেষে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ এসব বিনে জমানো পুরো ময়লাই সদরঘাট পৌঁছে বুড়িগঙ্গায় কিংবা বরিশাল, শরীয়তপুর, চাঁদপুর বা অন্য কোনো ঘাটে পৌঁছে সে অঞ্চলের নদীতে ফেলে দিচ্ছেন। কেননা সে ময়লা অন্যত্র নেওয়ার কোনো ব্যবস্থাই নেই। আর মানব বর্জ্য সাময়িকভাবে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই এসব নৌযানে। বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর দিয়ে অনেক ভিআইপি লঞ্চ চলে। সেগুলোতেও নেই  তেমন কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। পরিবেশ আন্দোলন বাংলাদেশের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিদিন যেভাবে বুড়িগঙ্গাকে দূষিত করা হচ্ছে, যার প্রভাবে অন্য অন্তত ছয়টি নদীও মারাত্মকভাবে দূষণের শিকার হচ্ছে। তাতে আগামী এক দশক পর হয়তো বুড়িগঙ্গার এই দূষণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়বে পদ্মা, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ, গোমতী এবং ধলেশ্বরীতে। বিশেষ করে নৌযানগুলো কোনো ধরনের নিয়মকানুন না মানা এবং বাংলাদেশে চলাচলকারী কোনো নৌযানেই মানব বর্জ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় এই দূষণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অন্য নদীতে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বলছে, রাজধানী ঢাকার ভিতরে-বাইরে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে মোট ১৮টি ছোট-বড় নদী। দখল আর দূষণে এর সবই আজ বিপন্ন। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রতিপক্ষ মানুষের বিরুদ্ধে লড়ছে বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা। আর জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে বুড়িগঙ্গার দূষিত পচা পানি ছড়িয়ে পড়ছে পদ্মা, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ, গোমতী এবং ধলেশ্বরীতে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য ড. মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা অত্যন্ত হতভাগা জাতি যে, নিজের ভালোটাও বুঝি না। এই নদী যদি না থাকে তাহলে পরিবেশ যে মারাত্মকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যে এর প্রভাব তো পড়তেও শুরু করেছে। নদীর পানিতে বর্জ্য বা যে কোনো ধরনের ময়লা ফেলা অন্যায়। আমাদের দেশে অবশ্য সে ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি, যার মাধ্যমে নৌযানগুলো নদীতে ময়লা ফেলা বন্ধ করতে পারে। এ ছাড়া বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে, এর পরিবেশ রক্ষায় এবং যাত্রীবাহী নৌযানের বর্জ্য সংরক্ষণ ও সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে তিনি মনে করেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লঞ্চ বা অন্য নৌযান বানানোর আগে যে নকশা করা হয় সেই নকশায়ও এ ধরনের কোনো নির্দেশনা থাকে না। ফলে মানব বর্জ্য সংরক্ষণ এবং অন্য ময়লা ধরে রেখে তা ডিসপোজ করার কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি নৌযানে কিংবা ঘাটে। জানা গেছে, এসব নদীতে চলাচলকারী ৭ শতাধিক যাত্রীবাহী নৌযানের কোনোটিতেই মানব বর্জ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এমনকি বিলাসবহুল জলযানেও সে ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশের নদীপথে চলাচলকারী কোনো নৌযানেই তৈরির সময় এমন ব্যবস্থা রাখা হয় না, যাতে মানব বর্জ্য সংরক্ষণ করা যায়। কিংবা অন্য ময়লা-আবর্জনা ফেলারও কোনো ব্যবস্থা নেই। যার ফলে নদীদূষণের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। মানুষের একটা ধারণাই সৃষ্টি হয়েছে যে, নদীতেই ময়লা ফেলতে হবে। অথচ আগে কিন্তু এমন ধারণা ছিল না। আগে নদীকে পবিত্র ভাবা হতো। নদী বাঁচাতে না পারলে আমরাও বাঁচব না। জাহাজ মালিকরা শুধু তাদের স্বার্থের কথা ভাবেন কিন্তু নদীর কথা ভাবেন না। এই নদীই যদি না থাকে তাহলে তারা জাহাজ কোথায় চালাবেন এটা ভাবা উচিত। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) মনে করে- বুড়িগঙ্গার পানি এতটাই দূষিত যে সেখানে মাছ বা কোনো পোকামাকড় বেঁচে থাকতে পারে না। বুড়িগঙ্গার এই মরণদশার বড় কারণ মানব বর্জ্য আর হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প-কারখানা। হাজারীবাগের ট্যানারি পল্লী সাভারে স্থানান্তর করা হলেও এর কোনো সুরাহা হয়নি। কেননা সেখানেও ইটিপি ঠিকমতো কাজ করছে না। যার ফলে সাভারের ট্যানারি পল্লীর ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরীতে। এটা মূলত বুড়িগঙ্গার পর এখন গলা টিপে মারা হচ্ছে ধলেশ্বরীকেও। আর এই ধলেশ্বরী এবং বুড়িগঙ্গার দূষিত পানি গিয়ে মিশছে অন্য নদীগুলোতে। জানা গেছে, এসব কারখানা থেকে প্রতিদিন প্রায় ২২ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য ও ১০ টন কঠিন বর্জ্যরে বেশির ভাগই ফেলা হয় ধলেশ্বরী আর বুড়িগঙ্গার পানিতে। এ বিষয়ে লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, লঞ্চ মালিকসহ যাত্রীদেরও সচেতনতার দরকার আছে। একই সঙ্গে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। এ ছাড়া যে কোনো লঞ্চের নকশা করার সময়ই এসব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে এ ধরনের সমস্যা থাকবে না বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, সিটি করপোরেশনের সহায়তায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নতুন কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিনের ময়লা যেন নদীতে না ফেলা হয় সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা একসঙ্গে কাজ করছি।

সর্বশেষ খবর