কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বে অনন্য রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। দেশের ১৬ কোটি মানুষের হিসাব ধরে প্রতি বছর আড়াই থেকে তিন কোটি টন খাদ্যের চাহিদা রয়েছে। যার পুরোটাই অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ করা হয়। তবে আপৎকালীন মজুদ হিসেবে সামান্য কিছু খাদ্যপণ্য আমদানি করা হয়। মাছ ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়, ধানে চতুর্থ, আলু উৎপাদনে সপ্তম। গরু-ছাগল উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। খাদ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) সারোয়ার মাহমুদ বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষি খাতও খুব ভালো পারফর্ম করছে। এজন্য প্রতি বছরই উৎপাদন বাড়ছে। খাদ্য মজুদ পরিস্থিতিও সন্তোষজনক।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ড. মো. আবদুল মুঈদ বলেন, ‘আমাদের কৃষি খাত অনেকের জন্যই অনুকরণীয়। এ খাতে ১০ বছর ধরে খুবই ভালো করছি। কৃষিতে নতুন উদ্ভাবনও অবদান রাখছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। উৎপাদন, মাড়াই, সংরক্ষণ সব ক্ষেত্রেই অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ।’
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুযায়ী সবজি ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। ধান ও আলু উৎপাদনে যথাক্রমে চতুর্থ ও সপ্তম অবস্থানে বাংলাদেশ। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন ৩ গুণের বেশি, গম ২ গুণ, সবজি ৫ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ।সাবেক কৃষি সচিব, খাদ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক আনোয়ার ফারুক বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রধান খাদ্য ভাত, মাছ, মাংস, শাকসবজির কোনোটাই আমাদের আমদানির প্রয়োজন হয় না। বরং কোনো কোনোটা রপ্তানির মতো সক্ষমতা রাখি। এটা এখন বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই অনুকরণীয়।’
জানা গেছে, স্বাধীনতার মাত্র তিন বছর পর ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ কাটিয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। কৃষিজ উৎপাদন বাড়ছে প্রতি বছরই। ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সবজি, মাছ-মাংস, ফল, ডালসহ প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের উৎপাদনে রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন ধরনের হিমায়িত মাছ, ফল, সবজি রপ্তানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। করোনা সংকটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্য সংকট হলেও বাংলাদেশে এর কোন ছোঁয়া লাগেনি। বরং জিনিসপত্রের দাম বাড়া সত্ত্বেও জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রয়েছে বলে মনে করে সরকার। পরিসংখ্যান বলছে, গত এক দশকে দেশের কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনের চেহারা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। দেশের কোথাও এক ইঞ্চি জায়গাও খালি না রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতি বাড়িতেই গড়ে উঠেছে খামার। নিজেদের সবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, মরিচ, পিঁয়াজ, মসলা দিয়ে জীবন ধারণ করছে মানুষ। দেশে প্রতি মাসে খাদ্য চাহিদার গড় ১৯ থেকে ২১ লাখ টন। যার প্রায় ৮০ ভাগই অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মেটানো হয়। খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে প্রতি বছর ৭০ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। এবার প্রায় ১৩ লাখ টন গম অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন হচ্ছে। এর বাইরে খাদ্যপণ্য হিসেবে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, শাকসবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে রেকর্ড করেছে। দেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের সদ্ব্যবহার করতে পারলে আগামী এক বছরে খাদ্য ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
খাদ্য মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা গেছে, ১৫ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত খাদ্যশস্যের সরকারি মোট মজুদ ৬ দশমিক ২ লাখ টন। এর মধ্যে চাল ৫ দশমিক ২১ লাখ, গম ৮১ হাজার টন। সাড়ে ৬ লাখ টন চাল আমদানি প্রক্রিয়াধীন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান মজুদ পরিস্থিতি সন্তোষজনক। এ ছাড়া এ মুহূর্তে খাদ্যশস্যের কোনো ঘাটতি নেই, ঘাটতির আশঙ্কাও নেই।
দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো কৃষি খাত। সনাতন পদ্ধতি থেকে সরে এসে এ খাতের উন্নয়ন হচ্ছে ক্রমাগত। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি, আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, নানামুখী কৌশলে রোগবালাই দমন, কৃত্রিম উপায়ে শাকসবজি ও মাছ চাষ, ছাদকৃষি প্রভৃতির মাধ্যমে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে এ খাতে। যার সিংহভাগ অবদান ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের। কৃষি ক্ষেত্রে যত ধরনের উদ্ভাবন ও নতুন জাত তৈরি করেছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা, তাঁদের বেশির ভাগই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। কৃষি ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্যের পেছনে রয়েছে এ দেশের কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রম আর কৃষিবিজ্ঞানীদের বিস্তর গবেষণা। ১৯৬১ সাল থেকে দক্ষ ও মানসম্মত কৃষিবিদ তৈরি করে যাচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ৫৮ বছরের গৌরবোজ্জ্বল পথচলায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অনেক সাফল্য। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্য ও ফলের জাত উদ্ভাবন, নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং নানামুখী জাত উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছেন। এখনো বিভিন্ন ধরনের গবেষণা কার্যক্রম চলমান। ধানের পাশাপাশি মাছ উৎপাদনে এবং দেশি প্রজাতির মাছ টিকিয়ে রাখতে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে তার মধ্যে প্রথম বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন। গত ১০ বছরে মাছের উৎপাদন ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। আর মাছ রপ্তানি বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। দেশি জাতের মধ্যে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বাংলাদেশে অধিক পরিচিত। মাংস সুস্বাদু হওয়ায় এ জাতের ছাগল ‘গরিবের গাভি’ নামে পরিচিত। বর্তমানে দেশে প্রায় ২ কোটি ৭৬ লাখ ছাগলের ৯০ শতাংশই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের। দ্রুত প্রজননশীল, উন্নতমানের চামড়া ও প্রতি প্রসবে একাধিক বাচ্চা দেওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী এ জাত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা দল (গবেষক এম এ এম ইয়াহিয়া খন্দকারের নেতৃত্বে) ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জীবনরহস্যও উন্মোচন করেছে। ফলে জনপ্রিয় এ জাতটির জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজনন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াসহ সব জৈবিক কার্যক্রম সম্পর্কে গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। দেশে মাংসের চাহিদা পূরণে বিশেষ চাহিদা রয়েছে মুরগির মাংসের। দেশি মুরগির উচ্চমূল্য ও উৎপাদনস্বল্পতার কারণে প্রাণিজ আমিষের বড় একটি অংশ পূরণ হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি দিয়ে। ডিমের জন্য লেয়ার মুরগির খামারও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পোলট্রি খাত শিল্পে পরিণত হয়েছে। এ খাতের অগ্রগতির পেছনেও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অপরিসীম।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সুদীর্ঘকালের পথচলায় এসেছে বহু সাফল্য। ইলিশ ও সিলভার কার্প মাছের স্যুপ ও নুডলস তৈরির প্রযুক্তি, শুকনা পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষের প্রযুক্তি, হিমায়িত ভ্রƒণ থেকে ভেড়ার কৃত্রিম প্রজনন, ভাগনা মাছের জাত উন্নয়ন, ডেঙ্গু ভাইরাসের সিরোটাইপ নির্ণয়ের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বাউকুল, ধান, সরিষা, সয়াবিন, আলু, মুখি কচুর বেশ কয়েকটি করে জাত উদ্ভাবন করেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে মাছ, সবজি ও বিভিন্ন রকমের ফল রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।