বুধবার, ৭ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

ভয়াবহ সংকটে করোনা চিকিৎসা

গত আট মাসে সাধারণ শয্যা কমেছে ৫ হাজার ২৫৯টি - আইসিইউ বেড়েছে ২০৩টি

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ভয়াবহ সংকটে করোনা চিকিৎসা

রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দা শাহরিয়ার হোসেনের গত ১ এপ্রিল করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। ৬২ বছর বয়সী এই ব্যক্তির রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস। ৩ এপ্রিল থেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেয় তার। চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুই দিন পার হতেই অবস্থার অবনতি হয়ে শুরু তীব্র শ্বাসকষ্ট। আইসিইউতে নিতে বলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে কোনো আইসিইউ ফাঁকা নেই। আইসিইউয়ের খোঁজে ঢাকার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের দুয়ারে যেতে থাকেন স্বজনরা। এদিকে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন রোগী। অবশেষে রাত ১০টায় শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে একটি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা হলে ভর্তি করা হয় তাকে।

শাহরিয়ার হোসেনের জামাই মির্জা আলিমুদ্দিন বলেন, ‘প্রত্যেকটা সরকারি হাসপাতালে আইসিইউয়ের জন্য গিয়েছি আমরা। রাস্তায় গাড়ি নেই কয়েক গুণ ভাড়া দিয়ে সিএনজি নিয়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে গিয়েছি। বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউয়ের খরচ বহন করার সামর্থ্য নেই আমাদের। বলতে কষ্ট লাগলেও সত্যি কথা হলো একজনের জীবন চলে গেলে ফাঁকা হচ্ছে আইসিইউ। তখন মুমূর্ষু আরেক রোগীকে আইসিইউতে নেওয়া হচ্ছে। এই সংকটে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায় অবস্থার অবনতি ঘটছে রোগীর। বাড়ছে মৃত্যু।’

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর বাড়তে থাকে সংক্রমণ। জুন-জুলাইতে সংক্রমণ গতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। জুলাইতে সর্বোচ্চ ৬৪ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কিন্তু এই রেকর্ড ভেঙে গতকাল দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে ৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সংক্রমণে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে রেকর্ড। গতকালও আক্রান্ত হয়েছে ৭ হাজার ২১৩ জন। এই বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা দিতে হাসপাতালগুলোতে তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ সংকট। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত হওয়ার তিন দিন পার না হতেই অনেক রোগীর শারীরিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফুসফুস। শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে

রোগী। প্রয়োজন হচ্ছে হাই ফ্লো অক্সিজেন ও আইসিইউ। কিন্তু শয্যা সংকটে মিলছে না চিকিৎসা। এর মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেক চিকিৎসক, নার্স দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে স্বল্প জনবল, স্বল্প শয্যায় বিপুল সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গতকাল সরকারি হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ ফাঁকা ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে এবং রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে কোনো আইসিইউ ফাঁকা ছিল না। কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে তিনটি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বার্ন ইউনিটে মাত্র একটি ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছয়টি আইসিইউ ফাঁকা ছিল। তবে সরকারি হিসাবে ১০টি ফাঁকা দেখালেও রোগী নিয়ে গিয়ে ভর্তি করাতে পারছেন না স্বজনরা। এমপি-মন্ত্রীকে ফোন দিয়েও সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ মিলছে না। রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত ১৫টি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল। এর মধ্যে স্কয়ার হাসপাতালে চারটি, ইউনাইটেড হাসপাতালে আটটি, এভারকেয়ার হাসপাতালে তিনটি আইসিইউ ফাঁকা ছিল। চট্টগ্রামে সরকারি হাসপাতালে ১৫টি এবং বেসরকারি হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল। সরকারি হাসপাতালের মধ্যে চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আটটি, বিআইআইটিতে পাঁচটি শয্যা এবং জেনারেল হাসপাতালে দুটি শয্যা ফাঁকা ছিল। বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল। গত বছর করোনা সংক্রমণ শুরুর পরেই স্বাস্থ্য খাতে সংকটের চিত্র উঠে আসে। গত বছরের ৯ জুলাই সারা দেশে করোনা রোগীদের জন্য শয্যা ছিল ১৪ হাজার ৯৪৫টি। আইসিইউ শয্যা ছিল ৩৯৪টি। রাজধানীতে সাধারণ শয্যা ছিল ৬ হাজার ৩০৫টি এবং আইসিইউ ছিল ১৪২টি। ৯ সেপ্টেম্বর সারা দেশের করোনা রোগীদের জন্য শয্যা ছিল ১৪ হাজার ৩১৩টি, আইসিইউ ছিল ৫৪৭টি। ঢাকার হাসপাতালে শয্যা ছিল ৬ হাজার ১০৫টি, আইসিইউ ছিল ৩০৭টি। এ বছরের ৯ মার্চ সারা দেশের করোনা রোগীদের জন্য শয্যা ছিল ১০ হাজার ২৮৩টি, আইসিইউ ছিল ৫৬৬টি। ঢাকার হাসপাতালে শয্যা ছিল ৩ হাজার ১৯৩টি, আইসিইউ ছিল ২৮১টি। গতকাল সারা দেশের করোনা রোগীদের জন্য শয্যা ছিল ৯ হাজার ৬৮৬টি, আইসিইউ ছিল ৫৯৭টি। ঢাকার হাসপাতালে শয্যা ছিল ৩ হাজার ৩৬৮টি, আইসিইউ ছিল ৩০৭টি। এই নয় মাসে হাসপাতালে সাধারণ শয্যা কমেছে ৫ হাজার ২৫৯টি এবং আইসিইউ বেড়েছে ২০৩টি। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ বছরের মার্চে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আমরা রাজধানীর হাসপাতালগুলো আরও ১০০টি আইসিইউ শয্যা সংযুক্ত করেছি। এর মধ্যেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১০টি করে আইসিইউ শয্যা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া মহাখালী ডিএনসিসি মার্কেট হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা বাড়নোর কাজ চলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা বাড়ানো সমস্যা না কিন্তু এ জন্য দক্ষ জনবল সংকটে। আইসিইউ ইউনিট চালানোর জন্য বিশেষ দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও ব্রাদার প্রয়োজন। আমাদের জনবলের সংকট রয়েছে।’ এ বছর মার্চের শুরু থেকে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রোগী শনাক্তের হার ছিল ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। পরের দিন ১ মার্চ শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৩১। গতকাল করোনা সংক্রমণের হার ছিল ২১ দশমিক শূন্য দুই। ৩৪ হাজার ৩১১টি নমুনা পরীক্ষা করে ৭ হাজার ২১৩ জনের শরীরে করোনার জীবাণু পাওয়া গেছে। গত তিন দিনে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ২১ হাজার ৩৭৫ জন। অথচ সারা দেশে সাধারণ শয্যা আছে ৯ হাজার ৬৮৬টি। অধিকাংশ করোনা রোগী বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে যেসব রোগীর হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ছে তারা পড়ছেন বিপাকে। হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে অবস্থার অবনতি হচ্ছে রোগীর। বাড়ছে করোনায় মৃত্যু। গত তিন দিনে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৭১ জন। এ ব্যাপারে কভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনার সঙ্গে আমাদের লড়াই চলছে। গত বছরও হাসপাতালে আইসিইউ সংকট ছিল, এ বছরও আছে। ২৮টি জেলাতে আইসিইউ আছে ৩৬টি জেলাতে নেই। এই জেলার রোগীরা বাঁচার আশায় ঢাকায় আসছে। ঢাকায় তো সংক্রমণ বেশি, আগে থেকেই সংকট আছে। রোগীরা এত পথ পাড়ি দিয়ে এসে দেখছে আইসিইউ নাই। আইসিইউ সংকটে অক্সিজেনের অভাবে রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে, বাড়ছে মৃত্যু। সময় গেলেও আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।’ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘এখন সরকারি নির্দেশনা মেনে না চললে আগামীতে করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু উভয়ই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যেতে পারে। আমরা এত বেপরোয়া হয়ে গেছি, মনে করছি করোনায় আক্রান্ত হব না। করোনার উৎপত্তিস্থল বন্ধ করতে হবে। নয়তো আমরা করোনার চিকিৎসা দিয়ে কূল পাব না।’ গতকাল রাজধানীর মহাখালী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মার্কেট হাসপাতালের নতুন ২০০টি করোনা আইসিইউ বেড ও ১০০০টি আইসোলেশন বেডের প্রস্তুতকরণ কাজের অগ্রগতি দেখতে গিয়ে এসব কথা বলেন। ডিএনসিসি মার্কেট হাসপাতালটি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে উদ্বোধন করা সম্ভব হতে পারে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর