মঙ্গলবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

খালেদা জিয়ার জন্য মেডিকেল বোর্ড

করোনায় আক্রান্ত সবার জন্য দোয়া চেয়েছেন, উদ্বিগ্ন বিএনপি, সার্বিক দেখভালে ডা. জোবায়দা রহমান

নিজস্ব প্রতিবেদক

খালেদা জিয়ার জন্য মেডিকেল বোর্ড

‘করোনায় আক্রান্ত বেগম খালেদা জিয়া ভালো আছেন। তাঁর মনোবল অত্যন্ত শক্ত। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও ভালো। এখন পর্যন্ত তাঁর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। যদি এভাবে আরও এক সপ্তাহ পার হওয়া যায় তাহলে আশা করা যায়, তিনি বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে যাবেন। বেগম জিয়া সবার কাছে নিজের ও করোনায় আক্রান্ত হওয়া বাংলাদেশের সবার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। নেতা-কর্মীসহ দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেছেন, সবাই যেন সাবধানে থাকেন। স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলেন।’

কথাগুলো বিএনপি চেয়ারপারসনের করোনা চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এফ এম সিদ্দিকীর। গতকাল বিকালে গুলশানে বেগম জিয়াকে দেখে এসে ‘ফিরোজার’ সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। অধ্যাপক ডা. এফ এম সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা বিকাল ৫টায় ‘ফিরোজায়’ প্রবেশ করেন। বেরিয়ে আসেন সন্ধ্যা ৬টার পরপরই। এরপর বেগম জিয়াসহ ফিরোজায় করোনায় আক্রান্ত সবার শারীরিক অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। এ দিকে নানা রোগ-শোকে থাকা বেগম খালেদা জিয়ার করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা। দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর মধ্যেই দুশ্চিন্তার ছাপ। গত দুই দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতা-কর্মীদের স্ট্যাটাসে এমন উৎকণ্ঠার দেখা মেলে। দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গেও আলাপচারিতায় হতাশার ছাপ পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে এখন শেষ আশা ভরসার স্থল বেগম খালেদা জিয়া। এর মধ্যে ৭৫ বছর বয়সী বয়োবৃদ্ধ খালেদা জিয়ার করোনা সত্যিই উদ্বেগের। কারণ, তাঁর অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আর্থারাইটিসহ বেশ কিছু জটিল রোগ আগে থেকেই আছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাসহ সাড়ে চারশ নেতা-কর্মী হারিয়েছে বিএনপি। আক্রান্তও প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী। তারপরও নেতা-কর্মীদের আশা, শিগগিরই সুস্থ হয়ে যাবেন বিএনপিপ্রধান। সারা দেশে গতকাল মসজিদে মসজিদে দোয়া ও মন্দিরসহ অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।

মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা সাংবাদিকদের বলেন, করোনায় আক্রান্ত ৭৫ বছর বয়সী বেগম খালেদা জিয়ার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো আছে। করোনায় আক্রান্ত বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থা খুবই স্থিতিশীল। তিনি যথেষ্ট ভালো আছেন। আজকে পর্যন্ত তিনি যথেষ্ট ভালো ও স্পিরিটেড আছেন। আশা করছি, যদি এভাবে আরও এক সপ্তাহ পার হওয়া যায় তাহলে ইনশা আল্লাহ আমরা বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে যাব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রয়েছেন। সবচেয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, যুক্তরাজ্যে তাঁর ছেলে তারেক রহমান ও পুত্রবধূ ডা. জোবায়দা রহমান তারা বিষয়টি তদারকি করছেন। আমরা একটা টিম ওয়ার্ক হিসেবে আলোচনা করে বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা করছি। কোথাও কোনো গ্যাপ বা কোথাও কোনো রকমের সন্দেহের কিছু অবকাশ নেই।

এ মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না- এমন প্রশ্ন করা হলে চিকিৎসক টিমের প্রধান বলেন, ‘কভিড-১৯-এ একটি অনিশ্চয়তা আছে। পৃথিবীর কেউ বলতে পারবে না যে, করোনা প্রথম সপ্তাহে কেমন থাকবে, দ্বিতীয় সপ্তাহে কী আচরণ করবে। কারও পক্ষে বলা সম্ভব না। সেজন্যই আমাদের প্রস্তুতি আছে। বিন্দুমাত্র আমাদের যদি মনে হয় যে, তাকে হাসপাতালে নেওয়া দরকার। আমরা সেই তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নিয়ে যাব। সেই ধরনের প্রস্তুতি আমরা রেখেছি। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে চিকিৎসক দলের সদস্য বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবদুস শাকুর খান, ইউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও ডা. মো. আল মামুন পাশে ছিলেন। চিকিৎসক টিমের এই বৈঠকে অনলাইনেও আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অংশ নেন। এ ছাড়া লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানও ইন্টারনেটে যুক্ত থেকে বৈঠকে অংশ নেন।

অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিকী বলেন, আমরা তিন-চারজন ছিলাম। বেগম জিয়া আমাদের সামনে এসে বসেছেন। আমি তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক দীর্ঘ বছর ধরে। এর আগেও তাঁকে যতবার আমি দেখেছি, সেভাবেই আজও দেখেছি। তিনি প্রস্তুত হয়ে এসে বসেন। আমাদের সামনে কথা বলেন। শুধু তাই নয়, আমি তাঁর পালস অক্সিমিটার দিয়ে দেখেছি। আমাদের পরীক্ষায় তাঁর কোনো শারীরিক জটিলতা দেখা যায়নি। অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিকী বলেন, সবাই কভিড পজিটিভ। তাদের প্রত্যেককে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ভালো দিক হচ্ছে বেশিরভাগেরই রোগের উপসর্গ আছে। প্রথম দিকে ১/২ জনের জ্বর ছিল। তাদের এখন জ্বর নাই। সবাইকে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ম্যাডাম শুধু নিজেরই না, আক্রান্ত হওয়া অন্যদেরও খবরাখবর রাখছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা যারা জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করি, তাদের আশা-ভরসার শেষ স্থল হচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। তাঁর করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবরে স্বাভাবিকভাবেই নেতা-কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বাসায় তার চিকিৎসা চলছে। আমরা আশা করছি, শিগগিরই তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন। তাঁর জন্য সারা দেশেই আমরা বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনা করছি। দেশবাসীর কাছেও আমাদের গণতন্ত্রের নেত্রীর জন্য দোয়া চাই। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমরা চেয়ারপারসনকে যেভাবে দেখেছি তাতে করে কঠিন বিপদেও তাঁর মনোবল শক্ত রাখতে পারেন। আমি যতটুকু খোঁজ নিয়েছি এখনো তাঁর মনোবল বেশ শক্ত। আশা করি, এই অবস্থায় সৃষ্টিকর্তার কৃপায় তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। তাঁর অসুস্থতা খবরে নেতা-কর্মীসহ দেশের আপামর সাধারণ মানুষও তাঁর জন্য প্রার্থনা করছে। আমি শুনেছি মুসলমান ভাই-বোনেরা নফল রোজা রেখেছেন, নামাজও আদায় করছেন। সৃষ্টিকর্তা আমাদের প্রার্থনা ফেলে দিতে পারবেন না বলে আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।

সুস্থতা কামনায় দোয়া ও প্রার্থনা : খালেদা জিয়ার আশু রোগমুক্তি ও সুস্থতা কামনায় গতকাল দেশব্যাপী বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে বাদ জোহর নয়াপল্টন জামে মসজিদে বিএনপির উদ্যোগে খালেদা জিয়ার আশু রোগমুক্তি কামনা করে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমান উল্লাহ আমান, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, ডা. রফিকুল ইসলাম, আবদুস সালাম আজাদ, শহীদুল ইসলাম বাবুল, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, তাইফুল ইসলাম টিপু, মুনির হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, কাজী রওনাকুল ইসলাম টিপু, সালাহউদ্দিন ভুইয়া শিশির, হায়দার আলী খান লেলিন, ওমর ফারুক শাফিন প্রমুখ। দোয়া মাহফিলে মোনাজাত পরিচালনা করেন ওলামা দলের আহ্বায়ক মাওলানা শাহ নেছারুল হক।

গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়েও খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় কোরআন খতম ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন নসু, ওলামা দলের মাওলানা আবদুল খালেক, মাওলানা মো. ইব্রাহিম, মাওলানা সোবহানসহ চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কমচারীরাও বেগম জিয়ার সুস্বাস্থ্য কামনায় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কোরআন খতম ও দোয়ার আয়োজন করে। এতে অংশ নেন ডা. আবদুল কুদ্দুস, অধ্যাপক ডা. গোলাম মুইনুদ্দিন, ডা. মো. নজরুল ইসলাম, ডা. সাইফুল ইসলাম সেলিম, ডা. ছফিউল্লাহ প্রমুখ।

এ ছাড়া হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্ট বিকালে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে হিন্দু নেতা-কর্মীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে অংশ নেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী গৌতম চক্রবর্তী এবং হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্ট নেতা সুকৃতি মন্ডল, অমলেন্দু দাস, রমেশ দত্ত, তরুণ দে, মিল্টন বৈদ্য প্রমুখ। এ ছাড়াও ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথকভাবে বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। দেশের বাইরেও বেগম জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় দোয়ার আয়োজন করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর