বুধবার, ৫ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

মমতার হ্যাটট্রিক শপথ আজ

বিধানসভায় দিনমজুর থেকে কোটিপতি, সহিংসতা চলছেই

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

মমতার হ্যাটট্রিক শপথ আজ

তৃতীয়বারের জন্য আজ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে চলেছেন তৃণমূল কংগ্রেসপ্রধান মমতা ব্যানার্জি। সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে রাজভবনে শপথ নেবেন তিনি। অনাড়ম্বর ওই অনুষ্ঠানে একাই শপথ নেবেন তৃণমূল সুপ্রিমো, তাঁকে শপথবাক্য পাঠ করাবেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা ভারতে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় খুব অল্পসংখ্যক অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। তাই এ অনুষ্ঠানে দেশের কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব উপস্থিত থাকছেন না বলেই খবর। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে এবং কলকাতার ব্রিগেডের ময়দানেই হবে সে বিজয় উৎসব। এর আগে সোমবারই রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপাল ধনখড়ের সঙ্গে দেখা করেন এবং সাংবিধানিক রীতি মেনে চলতি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ইস্তফা দেন মমতা। সেইসঙ্গে তৃণমূলের জয়ী বিধায়কদের সমর্থনের চিঠিও তুলে দেন রাজ্যপালের হাতে। আগামীকাল ও পরদিন শুক্রবার কভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে তৃণমূলের সদ্যবিজয়ী বিধায়করা শপথ নেবেন। আর করোনা সংক্রমণের কারণেই বিধায়কদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের জায়গাও বদল করা হচ্ছে। সাধারণত বিধানসভার নৌশের আলি কক্ষে বিধায়কদের শপথ গ্রহণ হয়, কিন্তু করোনা আবহেই বিধানসভার মূল সদনের ভিতরেই ছোট ছোট গ্রুপ করে বিধায়কদের শপথ পর্ব চলবে বলে জানা গেছে।

রবিবার রাজ্যটির ২৯৪ বিধানসভা আসনের মধ্যে ২৯২টির ফল ঘোষণা হয়। বিপক্ষকে পর্যদুস্ত করে ২১৩ আসনে জয় পায় তৃণমূল, ৭৭ আসনে বিজেপি আর ১টি করে আসনে জয় পায় সংযুক্ত মোর্চার (আইএসএফ) প্রার্থী ও স্বতন্ত্র দলের প্রার্থীরা। কিন্তু ২০০৬ সালে ২৩৫ আসন নিয়ে সরকার গড়া বামফ্রন্ট এবারের বিধানসভা থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ১৩০ বছরের দল কংগ্রেসেরও এবার একজন সদস্যও নেই। তবে এবারের বিধানসভায় দিনমজুর থেকে শুরু করে নতুন মুখ, পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ, কোটিপতি ব্যবসায়ী বিধায়কের মেলবন্ধন থাকছে। এ তালিকায় রয়েছন ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে জয়ী তৃণমূলের সিনিয়র মোস্ট ৭৮ বছর বয়সী শোভনদেব চ্যাটার্জি, ভাঙড় কেন্দ্র থেকে জয়ী সংযুক্ত মোর্চার (আইএসএফ) ২৮ বছরের নওশাদ সিদ্দিকি, কসবা কেন্দ্র থেকে চারবারের জয়ী তৃণমূলের বিধায়ক কোটিপতি জাভেদ খান (নির্বাচন কমিশনের দাখিল করা হলফনামা অনুযায়ী মোট সম্পত্তি ৩০ কোটি রুপি), তেমনি আছেন দুই বেলা খেটে খাওয়া দিনমজুর চন্দনা বাউরির মতো বিজেপির প্রার্থীরাও। যিনি এখনো মাটির ঘরে দিনযাপন করেন এবং বিদ্যুতের আলো যার ঘরে এখনো পৌঁছায়নি।

২০১৬ সালের তুলনায় মুসলিম বিধায়কের সংখ্যাও কমেছে। বিদায়ী বিধানসভায় মুসলিম বিধায়কের সংখ্যা ছিল ৫৯। এর মধ্যে তৃণমূলের ৩২, কংগ্রেসের ১৮ ও বামেদের নয়জন। কিন্তু এবারের নির্বাচনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪২-এ। এর মধ্যে তৃণমূলের ৪১ আর আইএসএফেএর মাত্র একজন। অন্যদিকে বিজেপি ৭৭ আসনে জিতলেও তাতে একজনও মুসলিম প্রতিনিধি নেই। এবারের জয়ী মুসলিম বিধায়কের মধ্যে অন্যতম তৃণমূলের ফিরহাদ হাকিম, জাভেদ খান, ইদ্রিস আলি, হুমায়ুন কবীর, সওকত মোল্লা, সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী এবং আইএসএফের নওশাদ সিদ্দিকি। বিধানসভায় মুসলিম বিধায়কের প্রতিনিধিত্ব কমে যাওয়ার কারণ কংগ্রেস ও বামেদের তরফে একজন প্রার্থীরও জয়ী না হওয়া। নিজেদের গড় বলে পরিচিত মুসলিম অধ্যুষিত মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এবার ডাহা ফেল কংগ্রেস। এ দুই জেলায় এবার মুসলিমরা উজাড় করে দিয়েছে তৃণমূলকে, দুই জেলা মিলিয়ে ২৬ আসন তুলে নেয় তারা। মেরুকরণের জোরেই এ এলাকা থেকে হিন্দু প্রার্থী দিয়ে দুটি কেন্দ্রে জয় ছিনিয়ে নেয় বিজেপি।

যদিও নারী বিধায়কের সংখ্যা মোটামুটি অপরিবর্তিই আছে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৪০ জন নারী জয়ী হয়েছিলেন। এর মধ্যে তৃণমূলের বিধায়ক ২৯, সিপিআইএমের ৬, কংগ্রেসের ৪, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার একজন বিধায়ক। কিন্তু এবারের নির্বাচনে মাত্র ৩৯ নারী জয়ী হয়ে বিধায়ক হিসেবে শপথ নিতে চলেছেন, শতাংশের নিরিখে মাত্র ১৩ শতাংশ। এবারে সর্বাধিক ৫০ জন নারীকে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। এর মধ্যে ৩৩ জন জয়ের মুখ দেখেছেন। যদিও দল বিপুল ভোটে জয়ী হলেও দলনেত্রী মমতা ব্যানার্জি পরাজিত হয়েছেন। বাকি সবাই বিজেপির। জয়ী নারী বিধায়কের মধ্যে অন্যতম তৃণমূলের শশী পাঁজা, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, নয়না ব্যানার্জি, সাবিত্রী মিত্র, রত্না চ্যাটার্জি, জুন মালিয়া, লাভলি মিত্র প্রমুখ। বিজেপির অগ্নিমিত্রা পাল, তাপসী মন্ডল, চন্দনা বাউরি।

ভোট-পরবর্তী সহিংসতা চলছেই : রবিবার ভোটের ফল ঘোষণার পর থেকেই রাজ্যটির জেলায় জেলায় রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটেই চলেছে। ইতিমধ্যে একাধিক মানুষের প্রাণ গেছে। সেইসঙ্গে বাড়ি, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়, দোকান, গাড়ি লক্ষ্য করে ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ হয়েছে। শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। কিন্তু সহিংসতা কিছুতেই থামছে না। গতকালও বিভিন্ন জেলা থেকে সহিংসতার খবর এসেছে।

এমন এক পরিস্থিতিতে গতকাল রাজ্যে এলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা। এদিনই দুপুরে কলকাতা বিমানবন্দরে নামেন তিনি। সেখানে দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, কেন্দ্রীয় নেতা মুকুল রায়, সাংসদ লকেট চ্যাটার্জি, রাহুল সিনহার সঙ্গে বৈঠক করে বিস্তারিত খোঁজখবর নেন। পরে নাড্ডা বলেন, ‘বাংলায় ভোটের ফলাফলের পর যে ঘটনা হচ্ছে তা চিন্তাজনক। কারণ এসব ঘটনা দেশভাগের সময় হয়েছিল কিন্তু এই স্বাধীন ভারতে এমন অসহিষ্ণুতা আগে দেখিনি। আমরা গণতান্ত্রিকভাবে লড়াই করার জন্য তৈরি।’ এরপর বিমানবন্দর থেকে চলে যান দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সোনারপুরে। সেখানে আক্রান্ত বিজেপি কর্র্মীদের বাড়ি যান, কথা বলেন তাদের সঙ্গে। এদিকে ভোট-পরবর্তী সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। গতকাল রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে টেলিফোন করে চলমান পরিস্থিতি জানতে চান মোদি। পরে টুইট করে রাজ্যপাল জানান ‘প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছিলেন এবং রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আমিও নিজের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। এখানে লুটপাট, মারধর, খুনের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি স্বাভবিক করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগী হওয়ার প্রয়োজন।’ এর আগে সোমবারই রাজ্য সরকারের কাছ থেকে বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপের আরজি জানিয়ে সেদিনই রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিজেপির এক প্রতিনিধি দল। এরপর সন্ধ্যায় রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে যান মমতাও। প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা ওই বৈঠকেও প্রাধান্য পায় ভোট-পরবর্তী সহিংসতার বিষয়টি। ভোট-পরবর্তী সহিংসতার জের গড়াল দেশটির শীর্ষ আদালত পর্যন্ত। সুপ্রিম কোর্টে এ সম্পর্কিত একটি মামলা করেছেন বিজেপির মুখপাত্র আইনজীবী গৌরব ভাটিয়া। এ ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবিও জানিয়েছেন গৌরব। অন্যদিকে দলের ১৮ জন সাংসদ ও ৭৭ জন বিধায়ক হওয়া সত্ত্বেও আক্রান্ত দলীয় কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে না পেরে ইস্তফার ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্যারাকপুরের বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং। তিনি বলেন, ‘এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের চোখ বন্ধ করে বসে থাকা উচিত নয়। আমরা এতজন প্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও যদি মানুষের পাশে না দাঁড়াতে পারি তবে আমরা ইস্তফা দিয়ে দেব। না হয় রাষ্ট্রপতি ভবন বা রাজভবনের সামনে অনশনে বসব।’ আর বিজেপি কর্মীদের ওপর হামলার পরিপ্রেক্ষিতে এবার মমতা ব্যানার্জি ও তাঁর দলের সাংসদদের সরাসরি হঁশিয়ারি দিলেন দিল্লির বিজেপি নেতা প্রবেশ সিং বর্মা। টুইট করে তাঁর বার্তা, ‘মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সাংসদরা যেন মনে রাখেন যে তাদেরও দিল্লি আসতে হবে।’ তাঁর অভিমত, নির্বাচনে হারজিত হয়। কিন্তু নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুরনো তিক্ততা ভুলে যাওয়া উচিত। সবাইকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করতে হবে। এদিকে দলীয় কর্মীদের হামলার অভিযোগে বুধবার (আজ) মমতার শপথের দিনই দেশজুড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান স্থগিত রাখারও দাবি জানিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। গোটা পরিস্থিতির বিষয়টি আঁচ করে গতকাল সন্ধ্যায় এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন মমতা ব্যানার্জি। কালীঘাটে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি, কলকাতা পুলিশের কমিশনার।

শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে থাকছেন যাঁরা : আজকের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও সিপিআইএম নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুকে। আমন্ত্রিতের তালিকায় রয়েছেন বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, বিজেপি নেতা মনোজ টিক্কা, কংগ্রেস সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরী, সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য্য, আবদুল মান্নানের মতো নেতারাও। এ ছাড়া এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন তৃণমূল সাংসদ দীপক অধিকারী (দেব), সুব্রত বক্সী, সদ্যবিজয়ী বিধায়ক শোভন দেব চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত মুখার্জি, পার্থ চ্যাটার্জি, ফিরহাদ হাকিমের মতো তৃণমূল নেতারা। তবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বড় চমক ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ও বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলিকে আমন্ত্রণ জানানো। তবে সৌরভ ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন কি না নিশ্চিত নয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে মমতা চলে যাবেন রাজ্য সরকারের সচিবালয় নবান্নে। সেখানে কলকাতা পুলিশের তরফে মমতাকে দেওয়া হবে গার্ড অব অনার। ওই অনুষ্ঠান শেষে মমতা সোজা চলে যাবেন চৌদ্দতলায় নিজের ঘরে। করোনা মোকাবিলায় নবান্নে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসবেন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর