ঈদের ছুটিতে যেভাবে বাড়ি গেছে সেভাবেই ঢাকায় ফিরছে মানুষ। ঈদ কাটিয়ে গাদাগাদি করে ফেরিতে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ঢাকায় ফিরছে তারা। এর আগে ঈদের ছুটিতেও গাদাগাদি করে মানুষ ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলে ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করেছিল। গতকালও ঢাকামুখী মানুষের ঢল ছিল বাংলাবাজার-শিমুলিয়া এবং দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে।
এদিকে যানবাহনের চাপ ছিল বিভিন্ন মহাসড়কেও। ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি মানুষ ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলে ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় ফিরছে। তবে কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই ছিল না। স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে গাদাগাদি করে আবারও পরিবার নিয়ে ঢাকায় ফিরছেন কর্মজীবী মানুষেরা। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে লকডাউনের মধ্যে রাস্তায় নামায় ৯৭টি দূরপাল্লার বাসের চালক-মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে গাজীপুরের পুলিশ।
আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যানুযায়ী- ঈদের ছুটি শেষে গতকাল ঢাকামুখী কর্মজীবী মানুষের ঢল ছিল বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটে। সরেজমিন দেখা গেছে, সকাল থেকেই বাংলাবাজার ঘাটে ঢাকামুখী মানুষের ঢল। এই নৌরুটে ১৮টি ফেরি চলাচল করছে। তবে দক্ষিণাঞ্চলমুখী যাত্রীদের চাপ নেই বললেই চলে। ঢাকামুখী যাত্রীদের চাপ ছিল বেশি।
বিআইডব্লিউটিসির এজিএম শফিকুল ইসলাম জানান, সকাল থেকে এই নৌরুটে ১৮টি ফেরি চলাচল করছে। শিমুলিয়া ঘাটে ফেরির অপেক্ষায় কোনো যান বা যাত্রী নেই। তবে বাংলাবাজার ঘাটে যাত্রীদের চাপ রয়েছে। স্বজনদের সঙ্গে ঈদ শেষ করে আবারও গাদাগাদি করে ফেরিতে পদ্মা পার হচ্ছে দক্ষিণ জনপদের কর্মজীবী হাজারো মানুষ। স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে যাত্রীরা ফেরিযোগে ফিরছেন। এতে যাত্রীদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুলিশ প্রশাসনসহ ঘাট কর্তৃপক্ষকে। যাত্রীরা স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন। যাত্রী ও যানবাহন পারাপারে ফেরিতে বেশ চাপ রয়েছে। লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল বন্ধ থাকার কারণে ফেরিতে যাত্রী চাপ বেড়েছে।
দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে ভোগান্তি : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ উপেক্ষা করে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে ঢল নেমেছে ঢাকামুখী যাত্রীর। ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। সকাল থেকেই দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে ঢাকামুখী যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছোট ছোট গাড়িতে যাত্রীরা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় পৌঁছান।
বিকালে মাগুরা থেকে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে আসা যাত্রী বিকাশ কর্মকার বলেন, মাগুরা থেকে ৪০০ টাকা ভাড়া দিয়ে ব্যাটারিচালিত মাহেন্দ্র গাড়িতে দৌলতদিয়া ট্রাক টার্মিনালে আসি। সেখান থেকে ৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে দৌলতদিয়ার ৫ নম্বর ফেরিঘাটে যাই। সেখানে দুটি ফেরি দেখে ফেরিতে উঠলে কর্তৃপক্ষ বলে এখন ৩ নম্বর ফেরিঘাট থেকে ফেরি ছেড়ে যাবে। আবার সেখান থেকে কষ্ট করে ৩ নম্বর ফেরিঘাটে যাই। তিনি বলেন, মহাসড়ক থেকে বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা টিকিট ছাড়া অন্য কোনো কথাই বলে না। ফেরিতে উঠলে তারা অন্য ঘাটে যেতে বলেন। আরেক নারী যাত্রী রেশমা খাতুন বলেন, দৌলতদিয়া ফেরিঘাট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে ঢাকায় ফেরার ক্ষেত্রে ভোগান্তি পোহাতে হলো। দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. ফিরোজ শেখ বলেন, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে বর্তমানে ১৫টি ফেরি চলাচল করছে। সিরিয়ালের ভিত্তিতে ফেরি চলাচলের কারণে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
ট্রাকই ভরসা যাত্রীদের : ঈদের ছুটি শেষে ভোগান্তি নিয়েই কর্মস্থলে ফিরছে মানুষ। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ট্রাক-মিনিট্রাকই একমাত্র ভরসা ঢাকামুখী নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের। ট্রাকের ভিতর গাদাগাদি করে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই যেতে হচ্ছে কর্মস্থল ঢাকায়। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে বাস চড়ে গন্তব্যে রওনা হলেও বঙ্গবন্ধু সেতু পার হতে পারছে না। সেতুর গোলচত্বরে পুলিশ বাসগুলো আটকে দিয়ে যাত্রীদের নামিয়ে দিচ্ছে। ফলে এসব যাত্রী আরও মহাবিপাকে পড়ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাকে করে ঢাকায় যাচ্ছেন। একদিকে ভোগান্তি অন্যদিকে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে তাদের।
যাত্রীরা বলছেন, চাকরি বাঁচাতে যে কোনো উপায়ে তাদের ঢাকায় যেতেই হবে। যাত্রীবাহী বাস বন্ধ থাকলেও ট্রাক-মিনিট্রাক ও প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসের চাপ রয়েছে ব্যাপক। যাত্রী মুক্তার হোসেন জানান, গণপরিবহন বন্ধ। কিন্তু চাকরি বাঁচাতে ঢাকা যেতেই হবে। বাধ্য হয়ে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছি। এতে যেমন ভোগান্তি হচ্ছে তেমনি দ্বিগুণ টাকাও গুনতে হচ্ছে। যাত্রী আজিয়া খাতুন জানান, গার্মেন্টস খুলবে। সময়মতো না গেলে চাকরি থাকবে না। তাই ছোট ছোট মেয়েকে নিয়ে ট্রাকে করে যেতে হচ্ছে। বগুড়ার যাত্রী আইয়ুব আলী জানান, বগুড়া থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত বাসে এসেছি। এখান থেকে বাস ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন মহাবিপদে পড়ে গেছি। তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর ট্রাকে উঠে রওনা হচ্ছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই যেতে হচ্ছে। যাত্রী সাকিব আহমেদ জানান, করোনার কারণে বাস বন্ধ রেখেছে। কিন্তু ট্রাকে যেভাবে গাদাগাদি করে যেতে হচ্ছে তাতে বাস চালু থাকলেও ভালো হতো। অন্তত স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাওয়া যেত। ট্রাকে তো স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নেই। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোসাদ্দেক হোসেন জানান, যাত্রী বাস সেতু পার হতে দেওয়া হচ্ছে না। যাত্রীদের নামিয়ে বাসের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু ট্রাকে হাজার হাজার মানুষ পার হয়ে যাচ্ছে। মানবিক কারণে এসব রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
ঢাকামুখী মানুষের স্রোত : মোটর শ্রমিকদের বাধার মুখে রংপুর থেকে ঢাকায় যাচ্ছেন কর্মজীবী মানুষ। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও বিকল্প উপায়ে ঢাকামুখী মানুষের ভিড় দেখা গেছে নগরীর অর্জন মোড়ে। আরও দেখা গেছে, অনুমোদনহীন বাস, মাইক্রো ও প্রাইভেটকার ভাড়া করে মানুষ ঢাকামুখী যাচ্ছেন। অনেকে আবার ট্রাকে করেও যাচ্ছেন। যাত্রীদের অনেকেই স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বিষয়টি দেখে না দেখার ভান করছে।
সিরাজুল ইসলাম নামে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী জানান, কাজে যোগ না দিলে চাকরি চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই দুই হাজার টাকার চুক্তিতে একটি মাইক্রোবাসে করে ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। তার মতো অনেকেই মাইক্রো-ট্রাকসহ বিভিন্ন বাহনে ঢাকা যাচ্ছেন। অনেকে বসে আছেন মাইক্রোবাস কিংবা অন্য কোনো যানবাহনের অপেক্ষায়। যদিও ভাগে কোনো বাহন মিললে ভাড়া গুনতে হচ্ছে অস্বাভাবিক। এদিকে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় মোটর শ্রমিকদের দুর্দিন চলছে। তারা মাইক্রোবাস কিংবা বিকল্প পদ্ধতিতে যাতায়াতরত যানবাহনে চলাচলে প্রতিবাদ করছেন। তারপরও থেমে নেই ঢাকামুখী মানুষের স্রোত।
স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত : ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি শেষে এবার রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের কর্মস্থলে ফিরতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। লঞ্চ এবং দূরপাল্লা রুটের বাস বন্ধ থাকায় চাপ পড়েছে অভ্যন্তরীণ রুটের বাস, অবৈধ মাইক্রোবাস সার্ভিস এবং থ্রি হুইলারে। এসব যানবাহনে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের। বরিশাল থেকে কাঁঠালবাড়ী রুটের অবৈধ মাইক্রোবাস সার্ভিসে এবং থ্রিহুইলারে শত শত যাত্রী গন্তব্যে যাচ্ছেন। কোনো গণপরিবহনেই রক্ষা হচ্ছে না শারীরিক দূরত্ব। মাস্কও পরেনি অনেকেই। যাত্রীরা জানান, বরিশাল কাঁঠালবাড়ী পর্যন্ত বাস ভাড়া ২২০ টাকা। কিন্তু একই রুটে সিএনজিতে ৫০০ এবং মাইক্রোবাসে আদায় করা হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা করে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঘরমুখো মানুষের ভিড় : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গতকালও ঘরমুখো মানুষের ভিড় ছিল। তবে সরকারি বিধিনিষেধে দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় মাইক্রোবাস ও পিকআপে গাদাগাদি করে বাড়ি যাচ্ছেন তারা। কিন্তু মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। গতকাল নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার শিমরাইল মোড়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। এমদাদ হোসেন কুমিলার লাকসাম যাবেন। সড়কে বাস না থাকায় তিনি মালবাহী পিকআপে করে বাড়ি যাবেন। তিনি জানান, ঈদের আগে ভিড় থাকায় তিনি গ্রামে যেতে পারেননি। এখন বাস না থাকলেও সড়কে ভিড় কম থাকায় গ্রামে যাচ্ছেন।
গাজীপুরে দূরপাল্লার ৯৭ গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা : নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে লকডাউনের মধ্যে রাস্তায় নামায় ৯৭টি দূরপাল্লার বাসের চালক-মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে গাজীপুরের পুলিশ। গাজীপুর শহরে ৪৫টি, চন্দ্রা ও কোনাবাড়ী এলাকায় ৪৬টি ও শ্রীপুর উপজেলার মাওনা-চৌরাস্তা এলাকায় ছয়টি বাসের মালিক ও চালকের বিরুদ্ধে এসব মামলা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে। ঈদের পর রবিবার থেকে গাজীপুরের সড়ক-মহাসড়কে লোকাল বাস, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মিনিবাসসহ বিভিন্ন পরিবহনে বাড়ি ফেরত মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। এ ছাড়া পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, অটোরিকশা চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। রবিবার বিকাল থেকেই বিভিন্ন গাড়িতে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের চাপ রয়েছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনার (উত্তর) মেহেদী হাসান জানান, সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দূরপাল্লার কিছু বাস ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে চলাচল করছিল। এসব বাসে চড়ে ঈদ শেষে যাত্রীরা পরিবার-পরিজন নিয়ে আবার কর্মস্থলে ফিরছেন। রবিবার বিকাল থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ ধরনের ৪৫টি বাসের চালক ও মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে এবং রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অভিযোগে আরও ১০টি গাড়িকে ড্যাম্পিং করা হয়েছে।
গাজীপুরের কোনাবাড়ীর সালনা হাইওয়ে থানার ওসি মীর গোলাম ফারুক জানান, চন্দ্রা ও কোনাবাড়ী এলাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে দূরপাল্লার ৪৬টি বাসের চালক-মালিকের বিরুদ্ধে মামলা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় চারটি গাড়িকে আটক করা হয়েছে। মাওনা হাইওয়ে থানার ওসি কামাল হোসেন জানান, শ্রীপুর উপজেলা মাওনা-চৌরাস্তা এলাকায় রবিবার সন্ধ্যায় দূরপাল্লার বাস যাত্রী নিয়ে চলাচলের চেষ্টা করলে ৬টি বাসের চালকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।