সোমবার, ২৪ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

বিটুমিন আমদানির চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিটুমিন আমদানির চোরাবালিতে রিজার্ভ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা। অঙ্কটা ঠিক কত, সেটি নিখুঁতভাবে বলা মুশকিল। তবে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে গত এক দশকে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে অন্তত ১৪ হাজার কোটি টাকা। বিটুমিন আমদানির পরিমাণ, এর গুণগত মান এবং আন্তর্জাতিক বাজারদর বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানা গেছে। অর্থ পাচারের প্রকৃত অঙ্কটা আরও বড় হতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। সড়ক-মহাসড়ক টেকসই  হয় এমন বিটুমিন ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা জারি আছে সরকারের তরফে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় বছরের পর বছর কেবল ভাঙে আর ভাঙে নতুন নির্মিত সড়ক। এর পেছনে গচ্চা যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বিটুমিনের মান যাচাই করতে নেমে পাওয়া গেল অর্থ পাচারের অবিশ্বাস্য চোরাবালি, যেখানে প্রতিবছর হারিয়ে যাচ্ছে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৬৬১ টন বিটুমিন আমদানি করেছে ৪২টি প্রতিষ্ঠান। ৩৪৬টি চালানে আনা বিটুমিনগুলোর এসেসমেন্ট ভ্যালু দেখানো হয়েছে ১ হাজার ১১০ কোটি টাকা। বাল্ক ও ড্রামে আমদানি করা এসব বিটুমিন কাস্টমস থেকে খালাস করা হয় ৬০-৭০ গ্রেড ঘোষণা দিয়ে। কিন্তু এগুলোর মান নিয়ে তৈরি হয় সন্দেহ। সত্যিকার অর্থে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন দিয়ে রাস্তা নির্মাণ হলে তা খুবই টেকসই হওয়ার কথা, যা বাস্তবে দেখা যায় না। তাই সড়ক-সংশ্লিষ্টরাও এসব বিটুমিনের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

কয়েকজন আমদানিকারকের সঙ্গে কথা বললে তারা অবলীলায় এগুলোকে উন্নত গ্রেড বলে দাবি করেন। কিন্তু  অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে রহস্য। আমদানি করা বিটুমিনগুলো আসলে উন্নত মানের নয়। ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় এসব বিটুমিনের কোনো কোনোটির গ্রেড পাওয়া গেছে ১০২, কোনোটি ৯৫, আবার কোনোটি ৯৮। বিটুমিন বিশেষজ্ঞরা এগুলোকে আলকাতরার চেয়েও নিম্নমানের বলে দাবি করছেন। সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারাও বলছেন, আমদানি করা বিটুমিনের কোনো মানই নেই। বিএসটিআই, বুয়েট ও বিপিসির কোনো অনুমোদন ছাড়াই এগুলো খালাস হয়ে হরহামেশা ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে রাস্তা কোনোভাবেই টেকসই হচ্ছে না। অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিবিদ এবং এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এসব বিটুমিনকে ৬০-৭০ গ্রেড ঘোষণা দেওয়া একটি পরিকল্পিত কৌশলমাত্র। আসলে পুরো ঘটনাটি বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের একটি ফাঁদ।

আন্তর্জাতিক বাজারদর যাচাই করে দেখা গেছে, ৮০-১০০ গ্রেড মানের বিটুমিনের বাজারমূল্য ১৫০ থেকে ১৮০ ডলারের মধ্যে ওঠানামা করে। গড়ে ১৬০ ডলার বা ১৩ হাজার ৬০০ টাকা দর বিবেচনায় নয় মাসে আমদানি করা বিটুমিনের প্রকৃত মূল্য দাঁড়ায় ৪৩৪ কোটি ৭৩ লাখ ৮৯ হাজার ৬০০ টাকা। অথচ নয় মাসে আমদানিকারকরা বিদেশে পাঠিয়েছেন ১ হাজার ৫২২ কোটি টাকা।

এনবিআরের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছর খালাসকৃত বিটুমিনের টনপ্রতি মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে গড়ে ৫৬০ ডলার বা ৪৭ হাজার ৬০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি টন বিটুমিনের বিপরীতে বিদেশে পাঠানো হয় বাড়তি ৩৪ হাজার টাকা। ফলে বিটুমিনের প্রকৃত মূল্যের বাইরে বাড়তি প্রায় ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিবছর গড়ে ৪ লাখ ২০ হাজার টন বিটুমিন আমদানি করে প্রতিষ্ঠানগুলো। এ হিসাবে প্রকৃত মূল্যের বাইরে প্রতিবছর বিদেশে পাচার হচ্ছে অন্তত ১ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা ১০ বছরে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ২৮০ কোটিতে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, ‘বিটুমিন আমদানিকারকরা যদি অর্থ পাচার করে থাকেন তাহলে তা দেখার আইনগতভাবে দায়িত্ব আছে আমাদের। অর্থ পাচার বিষয়ক কিংবা মানি লন্ডারিং কিংবা সন্ত্রাসে অর্থায়ন- এগুলো প্রতিরোধের দায়িত্ব কেন্দ্রীয়ভাবে বিএফআইইউকে দিয়েছে সরকার। কিন্তু এ বিষয়টি এখনো আমাদের নজরে কেউ আনেনি। আমি এ বিষয়ে ইউনিটে খবর নেব।’

তিনি বলেন, ‘মানি লন্ডারিং নিয়ে কোনো অভিযোগ কিংবা গণমাধ্যমে কোনো রিপোর্টে এলে সেটি নিয়ে আমরা কাজ করি। আমরা সেগুলো তদন্ত করি ও সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সবাইকে এ অভিযোগ তদন্ত করার জন্য প্রেরণ করি। সুতরাং নি¤œমানের বিটুমিন আমদানির আড়ালে যদি অর্থ পাচার হয়ে থাকে, এমন কোনো রিপোর্ট হলে আমরা অবশ্যই তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে ৪২টি প্রতিষ্ঠান ৩৪৬টি চালানে বিটুমিন আমদানি করেছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের তথ্যমতে, গত অর্থবছর (২০১৯-২০) আমদানি করা বিটুমিনের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৮০ হাজার ২৭৫ টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৭৪১ টন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেডভেদে মূল্য অনেক রকম হলেও সব মানের বিটুমিনের ডিউটি একই। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অল্প দামে নিম্নমানের বিটুমিন এনে উন্নত মানের বিটুমিন উল্লেখ করা হয়। বিদেশে টাকাও পাঠানো হয় উন্নত মানের দর অনুযায়ী।

জানা গেছে, ড্রামে পেট্রোলিয়াম বিটুমিন আমদানিতে কাস্টমস ডিউটি প্রতি টনে ৪ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারিত। এ ছাড়া এর ওপর ২ শতাংশ অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি) এবং ৫ শতাংশ অ্যাডভান্স ট্যাক্স (এটি) দিতে হয়। তবে বাল্ক আকারে আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি টনে ৩ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারিত এবং ২ শতাংশ এআইটি এবং ৫ শতাংশ এটি দিতে হয়।

বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) উৎপাদন করছে মাত্র ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন। বিপুল ঘাটতির সুযোগ নিয়ে দেশে গড়ে উঠেছে আমদানিকারকদের একটি শক্তিশালী চক্র। অর্থ পাচারের কৌশল জিইয়ে রাখতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিটুমিন ব্যবহারের সরকারি নির্দেশনাকেও পাত্তা দিচ্ছে না সংঘবদ্ধ চক্রটি। ফলে আমদানি করা মানহীন ও ভেজাল বিটুমিন ব্যবহার একদ-ও কমেনি।

ইস্টার্ন রিফাইনারির কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানি করা বেশির ভাগ বিটুমিনই ৮০-১০০ গ্রেডের। বিটুমিন আমদানির এলসি খুলে কার্যত আনা হয় ভেজাল কেরোসিন মেশানো আলকাতরা। কিন্তু আমদানিকারকরা ঠিকই উন্নত গ্রেড দেখিয়ে সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করছেন। বিপিসির একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএসটিআই, বুয়েট ও বিপিসির কোনো অনুমোদন ছাড়াই ভেজাল বিটুমিন বন্দর থেকে খালাস করা হচ্ছে। ফলে কোনো রকম পরীক্ষায় অবতীর্ণ না হয়েও খুব সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে অসাধু সিন্ডিকেটটি।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিটুমিন আমদানির আড়ালে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। অর্থাৎ যে দামে বিটুমিন কেনা হচ্ছে, এর চেয়ে অনেক বেশি দাম দেখানো হচ্ছে। এখানে অতিরিক্ত টাকাটা বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বা পাচার করা হচ্ছে।

নি¤œমানের বিটুমিন প্রসঙ্গে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমি যখন দাম কম দিয়ে কিনব তখন অবশ্যই নিম্নমানের জিনিস পাব। এটা খুবই স্বাভাবিক। গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাটে ব্যবহার করা বিটুমিনের মান খুবই খারাপ। এক বছরের মধ্যে এসব রাস্তা ধসে যায়, দেবে যায় এবং টান দিলে পুরোটা উঠে যায়।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে যে বিটুমিন ব্যবহার করা হয়, পৃথিবীর কোনো দেশে এগুলো হয় না। সুতরাং বিটুমিনের ন্যূনতম মান নিশ্চিত করা উচিত।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশের বাইরে অর্থ পাচার আগেও ছিল এখনো আছে। আমরা সব সময় পরামর্শ দিয়ে থাকি যে, ব্যাংকগুলো এলসি খোলার সময় কী মূল্যমানের কী খোলা হচ্ছে সেটি দেখা এবং একই সঙ্গে বিশ্ববাজারে সংশ্লিষ্ট পণ্যের তথ্য-উপাত্তগুলো খতিয়ে দেখা। ওই মূল্যমানের পণ্য, যেটি আমদানিকারকরা ঘোষণা দিচ্ছেন, সেটি ঠিক আছে কি না, সেগুলো ক্রসচেক করে দেখা উচিত। বিশেষ করে মান ও দামের ক্ষেত্রে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কি না তা দেখা উচিত। বিটুমিন আমদানিকারকদের এখানে একটি সিস্টেমের ভিতরে আনতে হবে।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান  বলেন, আমদানিকারকদের এখানে দুটি বিষয় আছে। একটি হলো তারা নিম্নমানের বিটুমিন এনে অতিরিক্ত মুনাফা করছেন, অন্যটি প্রক্রিয়াগতভাবে ওভার ইনভয়েসিংয়ের কারসাজি। এ প্রক্রিয়ায় প্রকৃত মূল্য ও অতিরিক্ত মূল্যের মধ্যে যে ফারাক থাকে, তা দেশের বাইরে পাচার করা হয়।

তিনি বলেন, নিম্নমানের বিটুমিন আমদানিকারকদের এ প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার ঠেকাতে সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্টস ইউনিটকে ঘোষিত পণ্যের দাম ও কোয়ালিটি বিশ্ববাজারে যাচাই করে সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করতে হবে। একই সঙ্গে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় এ প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার বন্ধ করা যাবে না।

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আরও বলেন, মানহীন বিটুমিন ব্যবহারের কারণে সড়ক মেরামত ব্যয় গত এক দশকে অন্তত চারগুণ বেড়েছে। আমদানি করা ভেজাল বিটুমিনের ব্যবহার ঠেকাতে সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। তবু এটি প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার বন্ধে বড় বাধা আমদানিকারকদের একটি সিন্ডিকেট। তারা কম দামে নিম্নমানের বিটুমিন এনে অনুমোদন ছাড়াই নানা কৌশলে খালাস করছে। একদিকে অর্থ পাচার হচ্ছে, অন্যদিকে নিম্নমানের ভেজাল বিটুমিনে ক্ষতির মুখে পড়ছে সড়ক-মহাসড়ক। এতে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে সরকার। গুটিকয় আমদানিকারকের লোভের মাশুল দিচ্ছে দেশের মানুষ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর