মিয়ানমার থেকে আসা মাদক ইয়াবার চালানের বড় একটি অংশ পাচার হচ্ছে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। মাদক সিন্ডিকেট প্রবাসী বাংলাদেশিদের টার্গেট করে ইয়াবার চালান পাচার করছে। সেসব দেশে একশ্রেণির প্রবাসী বাঙালির সহায়তায় গড়ে তোলা হয়েছে ইয়াবাবাজার। বিশাল বিস্তৃতি ঘটানো হয়েছে মাদক নেটওয়ার্কের। সৌদিতে বাঙালি অধ্যুষিত প্রায় প্রতিটি শহরেই চলছে ইয়াবার রমরমা বাণিজ্য। সেখানে একাধিক সিন্ডিকেটের আওতায় ৪ শতাধিক সেলসম্যান রাতদিন মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবা পৌঁছানোর কাজে ব্যস্ত থাকছেন।
সূত্র জানান, সৌদিতে মাদক সিন্ডিকেটের তৎপরতার কারণে সে দেশে অবস্থানরত বাঙালিদের মধ্যে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, ইসলামী রীতিনীতিকে প্রাধান্য দিয়েই সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান তৈরি হয়েছে। সে দেশে মাদক কেনাবেচা, বহন ও মাদক আখড়া গড়ে তোলার বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে এবং মাদক মামলায় সৌদিতে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত কার্যকর রয়েছে। তা ছাড়া মাদকবাজার গড়ে তোলার পেছনে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ উত্থাপিত হলে তা বৈদেশিক কর্মসংস্থানকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন প্রবাসীরা। এদিকে মাদক পাচার ও বাজারজাতের ঘটনায় অনেক প্রবাসীর হাড়ভাঙা পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থের বড় অংশই ইয়াবাবাজারে খরচ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সৌদিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও প্রশ্নের মুখে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরবে ইয়াবা পাচার ও মাদকবাজার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দেশের মাদক মাফিয়া খ্যাত তিনটি সিন্ডিকেট তৎপর রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে দুটি সিন্ডিকেট কুমিল্লা এলাকার এবং অন্যটি কক্সবাজারের টেকনাফ এলাকার। অতিসম্প্রতি মুন্সীগঞ্জের এক মাদক ব্যবসায়ী রিয়াদে ১৭ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার হন। তার দেওয়া তথ্যসূত্র ধরেই সন্দেহভাজন অন্তত ১৭ প্রবাসী বাঙালি ও একজন রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করা হয়েছে। এর আগে কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার মহেশপুরের একজন ৫ হাজার পিস ইয়াবাসহ সৌদি পুলিশে আটক হন। প্রবাসীদের একাধিক সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লা মাদক সিন্ডিকেটের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণেই চলছে সৌদি আরবের ইয়াবাবাজার। মক্কা, মদিনা, রিয়াদ, জেদ্দা, আল কাসিম, ভাতা, হারাসহ প্রতিটি শহরেই এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে ইয়াবার একচ্ছত্র বাজার গড়ে তোলা হয়েছে। সেলসম্যানদের মাধ্যমে তা পৌঁছে যায় ঘরে ঘরে।। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের প্রতারণায় ও অল্প সময়ে দ্বিগুণ লাভের লোভে অনেক প্রবাসী ইয়াবা সিন্ডিকেটে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। ইয়াবা বাণিজ্যে পুঁজির নামে যারাই মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেছেন সিন্ডিকেটপ্রধানরা তাদেরই ইয়াবা দিয়ে কৌশলে সৌদি পুলিশে তুলে দিয়ে পাওনা টাকা পুরোপুরি আত্মসাৎ করেছেন।
ইয়াবা পুঁজির ফাঁদে পড়ে এক বছর ধরে অন্তত ৪৮ জন প্রবাসী সৌদির বিভিন্ন জেলে বন্দী রয়েছেন বলেও জানা গেছে।
ইদানীং ইয়াবা জব্দ ও গ্রেফতার বেড়েছে : গত কয়েক দিনে সৌদি পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্যদের অভিযানে আল কাসিম এলাকা থেকে মানিকগঞ্জের এক ব্যক্তিকে ৭০ পিস ইয়াবাসহ আটক করা হয়। এর দুই সপ্তাহ আগেই রিয়াদ থেকে মাদক সিন্ডিকেটের সদস্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন আটক হন। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আল কাসিম থেকে আরও দুই ব্যক্তিকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ আটক করা হয়। তাদের দুজনের বাড়ি নোয়াখালী। এ ছাড়া কুমিল্লা সদরের কালির বাজার ইউনিয়নের একজনও ইয়াবাসহ গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হন।
যেভাবে পাঠানো হয় ইয়াবা : মিয়ানমার থেকে জল ও স্থল পথে মেথাম্ফিটামিনযুক্ত মাদক ইয়াবা কেবল দেশেই ঢুকছে না, বরং দেশের ভূখন্ড ব্যবহার করে ইয়াবার ছোট-বড় চালান ভিনদেশেও পাচার হচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশি ও আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়ারা বাংলাদেশকে ইয়াবা পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। আকাশপথে ভিনদেশে ইয়াবা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি ডাক ও বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসকে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া সোনা চোরাচালানের মতো এয়ারলাইনস ক্রু ও বিমানবালাদের মাধ্যমেও ইয়াবা পাচার হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে সীমান্ত দিয়ে জল ও স্থল পথে চাহিদার তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ইয়াবা হামেশাই দেশে ঢুকছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ভিনদেশে পাচারের জন্যও চোরাকারবারি চক্র দেশে ইয়াবার মজদ গড়ে তুলছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর সৌদি আরবে ওমরাহ করতে যাওয়ার সময় বাঁশখালীর একজনকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে লাগেজভর্তি ১০ হাজার ৮০০ পিস ইয়াবাসহ আটক করেন নিরাপত্তারক্ষীরা। এয়ার অ্যারাবিয়ার একটি বিমানে শারজাহ হয়ে তার জেদ্দা যাওয়ার কথা ছিল। তখনই মূলত আকাশপথে ভিনদেশে ইয়াবার চালান পাচারের বিষয়টি প্রথমবারের মতো নজরে আসে। গত এক বছরে ঢাকা শাহজালাল ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে লুকিয়ে ইয়াবা পাঠানোর সময় অন্তত ১৪টি চালান আটক করা সম্ভব হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর জানিয়েছে, এসব ইয়াবা চালান জব্দের ঘটনায় নয়টি মামলা ও চারটি জিডি হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টদের নজরদারি এড়িয়ে অবৈধ উপায়ে বহুগুণ বেশি চালান সেসব দেশে পৌঁছে বলে ধারণা করা হয়। গেল এক বছরে বাংলাদেশ ছেড়ে জেদ্দা, কাতার, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিমানবন্দরে অবতরণের পর ইয়াবাসহ অন্তত ১১ বাংলাদেশি আটকের ঘটনা ঘটে।
সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দুই কর্মীকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ আটক করার ঘটনাও ঘটে। দুজনই বিমানের ফ্লাইট স্টুয়ার্ট পদে রয়েছেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রিয়াদের হোটেল র্যাডিসন ব্লুতে সৌদি পুলিশের মাদক নিয়ন্ত্রণ শাখা অভিযান চালিয়ে মাদকসহ তাদের আটক করে। তারা দেশ থেকে কৌশলে নিজেদের লাগেজে ইয়াবা ঢুকিয়ে নিয়ে যান এবং হোটেল থেকে মাদক সিন্ডিকেটের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন।