রবিবার, ১৮ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

ফের আফগানিস্তানমুখী জঙ্গিরা

চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্রপথে পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার তথ্য গোয়েন্দাদের, চারজন গ্রেফতার

সাখাওয়াত কাওসার

ফের আফগানিস্তানমুখী জঙ্গিরা

ফের আফগানিস্তানমুখী হচ্ছেন নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্যরা। গোপনে আনসার আল ইসলামের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাদের সদস্যদের আফগানিস্তান যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিতও করছেন। সম্প্রতি আফগানিস্তানের বড় একটি অংশ তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় সেখানে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েমে শরিক হওয়ার জন্য যুবকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এসব যুবকের মগজ ধোলাই করা হয়েছে। এরই মধ্যে আফগানিস্তানে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে অনেইে হিজরত করেছেন। তাদের অনেকে চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্রপথে পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তান পৌঁছেছেন এমন তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। বাকিরাও সে পথেই সুযোগ খুঁজছেন। আর এ বিষয়টি গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন ৮ মে আনসার আল ইসলামের চার সদস্যকে গ্রেফতারের পর।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আনসার আল ইসলাম উপমহাদেশের আল-কায়েদার শাখা বলে নিজেদের দাবি করে। সম্প্রতি গ্রেফতার ব্যক্তিরা জানিয়েছেন দুজন আফগানিস্তানে হিজরত করেছেন। অবশ্য এটা তাদের ভাষ্য। এ বিষয়ে আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট- যারা দেশকে ভালোবাসবে তারা কখনো এমন জঘন্যতম কাজ করতে পারবে না। একই সঙ্গে তাদের বোঝা উচিত কেউই আমাদের নজরদারির বাইরে নয়।’

জানা গেছে, আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলেন বেশ কিছু তরুণ-যুবা, যার একটি বড় অংশ উগ্রপন্থি ধারার কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক। সেই আফগান-ফেরত যোদ্ধাদের উদ্যোগেই ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি) কার্যত আত্মপ্রকাশ করে। আফগান-ফেরত মুজাহিদের বেশির ভাগই এর সঙ্গে যুক্ত হন। আফগান যুদ্ধের সময় তারা গেরিলা যুদ্ধ ও ভারী অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। হুজিকে নিষিদ্ধ করা হয় ২০০৫ সালের অক্টোবরে। এরপর বিএনপি সরকারের শেষ দিকে এক দফা ব্যর্থ হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে হুজি পুনরায় নাম পাল্টে ইসলামী গণ-আন্দোলন বা আইডিপি (ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি) নামে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসার চেষ্টা করে। তারা পল্টনে দলীয় কার্যালয় খোলে এবং নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করে।

জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া              গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের টানা অভিযানের মুখে চুপসে গিয়েছিলেন হুজির সদস্যরা। একে একে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন হুজির প্রধান আবদুস সালাম, একাংশের প্রধান মুফতি হান্নান (পরে ফাঁসি হয়েছে), শেখ ফরিদ, মাওলানা ইয়াহিয়াসহ অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা। তবে দেশের বাইরে অবস্থান করে এখনো হুজি সদস্যদের উৎসাহ ও মদদ দিয়ে যাচ্ছেন নড়াইলের সাবেক সংসদ সদস্য মুফতি শহীদুল ইসলাম, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা আবু বক্কর। আট বছর ধরে আনসার আল ইসলাম নামে হুজির সদস্যরা সক্রিয়। গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত এ সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা জসিম উদ্দিন রাহমানী বিভিন্ন সময় পরামর্শ করে আসছিলেন। এর পর তারই একনিষ্ঠ অনুসারী মাওলানা মাহমুদ হাসান গুনবী আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।

গোয়েন্দাসূত্র বলছেন, কয়েক বছর ধরে আনসার আল ইসালামের সদস্যরা বিভিন্নভাবে গোপনে কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছিলেন। ৪ মার্চ আনসার আল ইসলামের অপারেশন শাখার প্রধান মো. মাইনুল ইসলাম ওরফে মাহিন ওরফ মিঠু ওরফে হাসান, সংগঠনের ‘শেখ’ সোহান শাদ ওরফে বারা আবদুল্লাহ ও মুরাদ হোসেন কবিরকে গ্রেফতারের পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে অবগত হন গোয়েন্দারা। গ্রেফতার মাইনুল ঢাকায় মাদরাসা পরিচালনার নামে শিশুদের ‘জিহাদি’ প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। এ ছাড়া হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক নাশকতায় আফগান-ফেরত যোদ্ধাদের ‘মদদ’ ছিল। তাদের একজন সর্বশেষ গ্রেফতার আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক গুরু মাওলানা মাহমুদ হাসান গুনবী। বৃহস্পতিবার রাতে র‌্যাব তাকে গ্রেফতার করে। র‌্যাবসূত্র বলছেন, গুনবী তার অনুসারীদের বেশির ভাগ সময়ই জিহাদে অংশ নেওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। সাম্প্রতিক সময়ে তার বিভিন্ন বক্তৃতায় আফগানিস্তানের বিষয়টি তুলে ধরতেন। ঘনিষ্ঠদের তিনি আফগানিস্তানে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিভিন্ন সময়। জানা গেছে, আনসার আল ইসলামের জঙ্গিরা দীর্ঘদিন ধরে চুপচাপ থাকলেও বর্তমানে আফগান পরিস্থিতি তাদের উজ্জীবিত করে তুলেছে। এরই মধ্যে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছেন ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে। এমনই একটি ক্লোজ গ্রুপের নাম ‘সায়েন্স প্রজেক্ট’। এ চ্যাট গ্রুপের ১০ তরুণের মধ্যে তিনজন আফগানিস্তান যাত্রা করেছেন। তাদের দুজনের আফগানিস্তানে পৌঁছে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা। এ দুজন হলেন কুমিল্লার আবদুর রাজ্জাক ও সিলেটের শিব্বির আহমেদ। রাজ্জাক সিলেটে একটি মাদরাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি গাড়ি চালাতেন। তার সন্ধান চেয়ে ভাই সালমান খান ২৫ মার্চ সিলেটের কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন। আর রবিউল নামে নোয়াখালীর এক তরুণও আফগানিস্তানের উদ্দেশে বাড়ি ছেড়েছেন। তবে মে মাসে ওই গ্রুপেরই চারজনকে সিটিটিসি গ্রেফতার করে। তারা আফগানিস্তান যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল খায়রুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যে যা-ই করুক না কেন কেউই আসলে র‌্যাবের নজরদারির বাইরে নয়। মাঠে এবং সাইবারে আমাদের “২৪/৭” নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। তবে আমাদের একটাই বক্তব্য থাকবে- কেউ নিজেদের স্বার্থে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করবেন না। কারণ এটা শান্তির ধর্ম।’

সর্বশেষ খবর