বুধবার, ১৮ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

কী হবে আফগানিস্তানে

পাকিস্তান সীমান্তে ভিড়, প্রথম সংবাদ সম্মেলন, নতুন সরকার নিয়ে আলোচনা, জনজীবন স্বাভাবিক করার চেষ্টা তালেবানের, আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা, জাতিসংঘের বৈঠক

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

কী হবে আফগানিস্তানে

কাবুলের রাস্তায় তালেবানের সশস্ত্র মহড়া -এএফপি

তালেবানের কাবুল দখলের পর বিশ্বজুড়ে চলছে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা। কেমন হবে তাদের সরকার, কেমন হবে তালেবানের আচরণ, এবারের তালেবান কি আগের মতোই হবে নাকি নতুন চেহারায় আসবে, সাধারণ আফগানদের কী হবে, দেশ ছাড়তে আগ্রহীদের ভবিষ্যৎ কী, নারীদের ক্ষেত্রে কী হবে, আফগানিস্তান কি আবার বিশ্বের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে উঠবে- এসব নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে বিশ্বজুড়ে। পাশাপাশি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে এত দিন ধরে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো তাহলে আফগানিস্তানের কী করল। প্রশ্ন থাকলেও সঠিক উত্তর নেই কারও কাছে। সবার অপেক্ষা তালেবানের নতুন সরকার গঠনের গতিপ্রকৃতির দিকে। গতকাল কাবুলে তালেবানের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, ‘২০ বছর আগেও আমাদের দেশ মুসলিম রাষ্ট্র ছিল। আজও আছে।

কিন্তু অভিজ্ঞতা, পরিপক্বতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে ২০ বছর আগের সঙ্গে আজকের তালেবানের ব্যাপক তফাত রয়েছে। আমরা এখন যেসব পদক্ষেপ নেব তার সঙ্গে সেসময়কার তফাত রয়েছে এবং থাকবে। এটা বিবর্তনের ফসল।’ তালেবান মুখপাত্র বলেন, ‘আফগানিস্তানের মাটি কারও বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমরা এ নিশ্চয়তা দিচ্ছি। সারা দেশে পূর্ণ নিরাপত্তা বজায় রয়েছে। কেউ কাউকে অপহরণ করতে পারবে না। প্রতিদিনই আমরা নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না কেউ দেশ ছেড়ে যাক। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। কোনোরকম শত্রুতা বা প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। সবাই নিরাপদ থাকবে। কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানি করা হবে না। যুদ্ধে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তারা মারা গেছেন শত্রুপক্ষের হয়ে লড়াই করতে গিয়ে। তারা প্রাণ হারিয়েছেন নিজেদের দোষে। আমরা মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে গোটা দেশ জয় করে নিয়েছি।’

নারী অধিকারের প্রশ্নে তালেবান মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা নারীদের বাইরে কাজ করার এবং পড়াশোনার অনুমতি দেব, তবে তা হতে হবে আমাদের কাঠামোর মধ্যে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করতে চাই, কারোর ক্ষতি করা হবে না। আমাদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী চলার অধিকার আমাদের আছে। অন্য দেশের অন্য দৃষ্টিভঙ্গি, ভিন্ন নিয়ম, ভিন্ন বিধান থাকবে। আফগানদের মূল্যবোধের নিরিখে তাদের নিজস্ব আইন এবং বিধান আছে। শরিয়া আইনের অধীনে নারীর অধিকার রক্ষায় আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মুখপাত্র বলেন, ‘বেসরকারি মিডিয়া স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে। তবে মিডিয়ায় ইসলামী মূল্যবোধের পরিপন্থী কিছুই প্রচার করা যাবে না। মিডিয়াকে আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে দেওয়া হবে না। সংবাদমাধ্যম দেশ ও জাতির ঐক্যের লক্ষ্যে কাজ করবে।’ সরকার গঠনের পর সবকিছু পরিষ্কার হবে উল্লেখ করে মুখপাত্র বলেন, ‘সরকার গঠনের পর আমরা সিদ্ধান্ত নেব এবং দেশের জনগণকে জানাব, দেশ কোন আইনে চলবে। আমি স্পষ্ট বলতে চাই- সরকার গঠনের বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। আমাদের কাজ সম্পন্ন হলে আমরা এ বিষয়ে ঘোষণা দেব।’

এদিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর তথ্যানুসারে কাবুল দখলের পর আফগানিস্তানের জনজীবন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে তালেবান। তবে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক এখনো কাটেনি। দেশ ছাড়তে মরিয়া সাধারণ আফগানরা বের হওয়ার পথ খুঁজছেন। অনেকে ভিড় করেছেন পাকিস্তান সীমান্তে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তাদের হয়ে কাজ করা আফগানদের সেখান থেকে বের করার চেষ্টার কথা বললেও কার্যত কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে আফগানিস্তানে সরকার গঠনের আলোচনা। তালেবানের পক্ষ থেকে নতুন সরকারে নারীদের অংশগ্রহণ রাখার কথা বলা হয়েছে। তালেবানের কাবুল দখলের দিন চরম বিশৃঙ্খলার কারণে বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামা বন্ধ হয়ে যাওয়ার এক দিন পর কূটনীতিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের সরিয়ে নিতে আবার কাবুল বিমানবন্দর চালু হয়েছে। সোমবার একাধিক ছবিতে দেখা যায়, হাজার হাজার আফগান শহর থেকে পালাতে বিমানে ওঠার জন্য মরিয়া হয়ে রানওয়েতে দৌড়াচ্ছেন। সেখানে অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। যদিও এটা পরিষ্কার নয় যে তারা গুলিতে নাকি পদদলিত হয়ে মারা গেছেন। তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখন পরিস্থিতি অনেক শান্ত। পশ্চিমা একজন নিরাপত্তারক্ষী বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, আগের দিন যারা এখানে ছিলেন তারা অনেকে বাড়ি ফিরে গেছেন। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, মাঝেমধ্যে বিমানবন্দরের দিক থেকে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো থেকে জানা যায়, তালেবান আফগানিস্তানে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা শুরু করেছে। সব সরকারি কর্মচারীকে কাজে ফিরতে বলেছে এবং তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। যারা লুটপাটের সঙ্গে জড়াবে ধরা পড়লে তাদের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছে তালেবান। কাবুলে একটি টিভি অনুষ্ঠানে দেখা গেছে, একজন নারী উপস্থাপক এক তালেবান নেতার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। তালেবান ২০ বছর আগে যখন ক্ষমতায় ছিল তখন এটা অকল্পনীয় ছিল। প্রথম সারির টিভি চ্যানেল তোলোনিউজ তাদের এক নারী সংবাদদাতার ছবি টুইট করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি রাস্তায় ঘুরে রিপোর্টিং করছেন। তবে ক্যাফে, দোকান বা গাড়িতে এখন আর কোনো গান বাজতে শোনা যাচ্ছে না। বড় বড় পোস্টারে বা বিজ্ঞাপনে যেসব নারীর মুখ আছে সেগুলো রং দিয়ে মুছে দেওয়া হচ্ছে। তালেবান যোদ্ধারা লুটপাটে জড়িত রয়েছেন এ রকম খবরের পর তালেবানের উপনেতা মোলাভি ইয়াকুব অডিওবার্তা দিয়েছেন। এতে তালেবান যোদ্ধাদের কারও বাড়িতে প্রবেশ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আলোচনার মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনের আহ্বান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের : বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, আফগানিস্তানে ঐক্যবদ্ধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, প্রতিনিধিত্বমূলক এবং নারীদের সমান ও অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে আলোচনার মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। সোমবার বৈঠক করে আফগানিস্তানে অবিলম্বে সব ধরনের সহিংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে ১৫ সদস্যের এ পরিষদ।

আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা : কাবুল বিমানবন্দরের দৃশ্য সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে হাজার হাজার মানুষকে উড়োজাহাজে দেশত্যাগের জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা যায়। এ দৃশ্য নিয়ে আমেরিকার সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান পার্টির নেতারা একজোট হয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন। সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিশৃঙ্খলার জন্য তারা বাইডেনকে দোষারোপ করছেন। মার্কিন সেনা উপস্থিতিতে তালেবানের হাতে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ার বিষয়টি আমেরিকানদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সরাসরি বাইডেনের পদত্যাগ দাবি করেছেন। গভীর বেদনার কথা জানিয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। আফগান যুদ্ধে যেসব আফগান নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করেছেন তাদের দ্রুত উদ্ধার করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে তোপের মুখে থাকা প্রেসিডেন্ট বাইডেন জাতির উদ্দেশে ভাষণে উত্তর দিয়েছেন অনেক সমালোচনার। ভাষণে বাইডেন পরিস্থিতির জন্য কিছু দায় নিজের ওপর নিয়েছেন এবং কিছু দায় দিয়েছেন তার পূর্বসূরিদের ওপর। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা নির্ধারণ করে সমঝোতা করে গেছেন। সে অনুযায়ীই সব হয়েছে। কিন্তু এমন দ্রুততার সঙ্গে পুরো আফগান পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠবে বলে তার ধারণা ছিল না। তবে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত বাইডেন নিয়েছেন তা সঠিক বলে দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করেন তিনি। বাইডেন বলেন, ২০ বছরের আফগান যুদ্ধে বেশ মূল্য দিয়ে অনেক শিক্ষা হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের জন্য কোনো সময়ই ভালো ছিল না। সেনা প্রত্যাহারের কারণে যে কোনো ধরনের আকস্মিকতা মোকাবিলার জন্য তার প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা করে রাখা হয়েছিল। আরও কিছুদিন আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতির কোনো ব্যতিক্রম ঘটত না।

নিজেকে আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন সালেহ : নিজেকে আফগানিস্তানের বৈধ ও সাংবিধানিক অন্তর্বর্তী  প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন আশরাফ গনি সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমারুল্লাহ সালেহ। গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টুইটারে এক বার্তায় নিজেকে আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন তিনি। টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানের সংবিধান অনুসারে প্রেসিডেন্টের মৃত্যু, অনুপস্থিতি, পদত্যাগ বা পলায়নের ক্ষেত্রে ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হয়ে যান। আমি এখন নিজের দেশেই আছি। আমি বৈধ অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট। সব নেতার সমর্থন ও মত নেওয়ার জন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।’

যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে আফগানিস্তান থেকে শরণার্থী নেবে উগান্ডা : যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ রাখল উগান্ডা। ২ হাজার আফগান নাগরিককে আশ্রয় দিতে সম্মত পূর্ব আফ্রিকার এ দেশটি। মঙ্গলবার উগান্ডার ত্রাণ, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও শরণার্থী বিষয়ক জুনিয়র মন্ত্রী ইশথার আনিয়াকুন দাভিনিয়া বিষয়টি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, মার্কিন সরকার প্রেসিডেন্ট মুসাভানির কাছে অনুরোধ জানিয়েছিল। তিনি ২ হাজার আফগান শরণার্থীকে উগান্ডায় আনতে সম্মতি জানিয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর