বৃহস্পতিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বাবার গলা চেপে জমি লিখে নেন মিজান!

নিজস্ব প্রতিবেদক, কুমিল্লা থেকে

শুধু অন্যদের ব্ল্যাকমেল করে অর্থ আদায় করেই ক্ষান্ত হননি কুমিল্লার বহুল আলোচিত নুসরাত জাহান তানিয়া। স্বামী মিজানুর রহমান সানিকে কুপ্ররোচনা দিয়ে বৃদ্ধ শ্বশুরের কাছ থেকে স্বামীর নামে লিখিয়ে নেন জমি। বৃদ্ধ মফিজুর রহমান জমি লিখে দিতে রাজি না হওয়ায় তার গলা চেপে ধরে মারধর করেন। বাধা দিতে গেলে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে মারধর করেন সৎ মা এবং ছোট ভাই আল-আমিনকেও। বিষয়টি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার দৈয়ারা গ্রামের সবাই জানেন। কিন্তু মিজানের আশ্রিত মাস্তান বাহিনীর ভয়ে কেউ তাদের বিরুদ্ধে নাম প্রকাশ করে মুখ খুলতে চাইছেন না।

বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কথা হয় মিজানের বাবা মফিজুর রহমানের সঙ্গে। নুসরাতের কুপরামর্শে গলা চেপে ধরে জমি লিখে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘থাক বাবা, পুরনো বিষয়ে কথা বলতে চাই না। আমি সব সময় ঠকতে চাই। দুনিয়ায় ঠকলেও আমি আল্লাহর কাছে পাব। আল্লাহ আমাকে অনেক ভালো রাখছেন।’

মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি দুই বিয়ে করেছি। প্রথম ঘরে মিজানুর রহমান সানি, জিয়াউর রহমান ও রাসেল। আর দ্বিতীয় ঘরে আল-আমিন। আমি বাবা হয়ে ছেলেদের খারাপ বলতে পারি না। আমি ২০১৭ সালে হজে যাওয়ার আগে ছেলেদের প্রাপ্য অংশ তাদের বুঝিয়ে দিয়েছি। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। দোকান ভাড়া দিয়ে এবং নিজের দোকানে বসে সংসার চালাই। ছেলেরা আমার খোঁজ নিক বা না নিক তাতে কিছু আসে-যায় না।’

গলা চেপে ধরে জমির দলিলে স্বাক্ষর নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ওপরে থুতু মারলে নিজের গায়ে পড়ে। আমি এসব কথা বলতে চাই না। আমি বাপু সব সময় ঠকার চিন্তা করি। আমি বলছি জমি হোক টাকা হোক, তোরা নে সব। আমার স্ত্রীসহ অন্যরা বা আমি ঠকি কিছু আসে-যায় না। আমার থাকলে তাগোরে আরও দিতাম। যারা বেশি খাম-খাম করে, যাদের বেশি পয়সার দরকার, টাকার দরকার, তাগোরে পারলে সব দিয়া দিমু। আল্লাহ যদি দেয় তাহলে কেউ ঠেকায়ে রাখতে পারব না। তোরা নে।’ মনের ক্ষোভে-দুঃখে কথাগুলো বলার সময় মফিজুর রহমানের গলা ভারী হয়ে আসে। তার চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।

মিজানকে ছাত্রদলের কর্মী উল্লেখ করে তার বাবা বলেন, ‘মিজান সক্রিয়ভাবে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। তবে আগে ছাত্রদল করত। এখন কী করে জানি না। আমি তার বাসায় যাই না। সারা দিন দোকান, বাসা আর মসজিদ নিয়া থাকি।’ নুসরাতের সঙ্গে মিজানের বিয়ে প্রসঙ্গে মফিজুর রহমান বলেন, ‘মিজান নিজা বিয়া (নিজের বিয়ে) নিজে করছে। নুসরাত তাকে ফাঁসিয়েছে। পরে আর কী করব, আমার মানসম্মানের দিকে তাকিয়ে স্থানীয় আবদুল হাই বাবলুর মধ্যস্থতায় তাকে ঘরে তুলে নিই। আর এতেই আমার পরিবারে নানা অশান্তি নেমে আসে। আমি কখনো তাদের বাসায় যাই না। তার বিষয়ে শুনিও না।’

নুসরাতের শ্বশুর মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমার সঙ্গে যারা থাকতে চায়, যারা লোভী না, তাদের কারও সঙ্গে ঝামেলা হয় না। তারা (মিজান-নুসরাত) করুক, তারা যা খুশি করুক। আমি তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলব না। আল্লাহ তাগোরে হেদায়েত করুক।’ বৃদ্ধ আক্ষেপ করে বলেন, ‘তাদের যা লোভ, তারা শুধু চায়, আমার হাতে যদি ফান্ড থাকত তাহলে তাগোরে আরও দিতাম। আমি কাউরে ঠকাই না। কেউ যদি এটা না মেনে নিতে চায় তাহলে আমার কিছু করার নেই।’

নুসরাতের শ্বশুর ছেলে ও ছেলেবউয়ের লোভী আচরণের কথা প্রকাশ করলেও তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলতে চান না। তিনি শুধু মনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

কুমিল্লা-লাকসাম রেললাইন-সংলগ্ন ছোট্ট একটি গ্রাম দৈয়ারা। গ্রামের একদিকে পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড, অন্যদিকে জাঙ্গালিয়া বাস টার্মিনাল। শহরের কোলঘেঁষা শহরতলির ছোট্ট এই গ্রামের মানুষের মধ্যে কেমন যেন অজানা এক আতঙ্ক। গ্রামে মিজানের বাড়ি-সংলগ্ন তাদের এক প্রতিবেশী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এদের মতো খারাপ ও দুশ্চরিত্রের লোক হয় না। তারা লোভী ও স্বার্থপর। স্বার্থের জন্য দফায় দফায় তারা তার সৎ মাকে মারধর করেছে। ওই নারী তাদের ভয়ে বাসা থেকে বের হন না। কখন আবার তারা কী ক্ষতি করে! এলাকার মাস্তান ও ষন্ড শ্রেণির ছেলেদের সঙ্গে মিজানুর রহমান সানির সখ্য। এসব কারণে এলাকার মানুষও তাদের ওপর চরম বিরক্ত।’

এর আগে মিজান ও নুসরাতের লোভী মানসিকতা এবং স্বার্থপরতার কথা তুলে ধরেন নুসরাতের বড় চাচা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মো. শাহাদাত হোসেন সেলিম। তিনি বলেন, ‘আমার ভাতিজি নুসরাত ও তার স্বামী মিজানুর রহমান সানির অতিলোভের বলি হয়েছে আমার ছোট ভাতিজি মোসারাত জাহান মুনিয়া। তারা মুনিয়াকে তাদের স্বার্থে ও অবৈধ অর্থ রোজগারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। আমাদের সঙ্গেও মিশতে দিত না।’ মিজানকে ‘অসভ্য’ উল্লেখ করে সেলিম বলেন, ‘পরিবারের অমতে নুসরাত বিয়ে করে মিজানকে। এরপর সে আমার ছোট ভাতিজি মুনিয়াকে দিয়ে ধনসম্পদ অর্জনের অপচেষ্টা করে, যার পরিণতিতে মুনিয়ার করুণ আত্মহত্যা।’

নুসরাতের স্বজনরা জানান, ছোট বোন মুনিয়া ২০১৪ সালে ফেনীর নিলয় নামে এক যুবকের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। ওই ঘটনায় নুসরাত নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে মামলা করে নিলয় ও তার পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। নুসরাত নিজেও কয়েক দফায় বাড়ি থেকে বিভিন্নজনের সঙ্গে পালিয়ে বের হয়ে যান। একবার তাকে ময়মনসিংহ থেকে ধরে আনেন তার বাবা সফিকুল ইসলাম। নিলয়ের কাছ থেকে মুনিয়া মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পর মুনিয়াকে দিয়ে টাকা কামানোর নেশা পেয়ে বসে নুসরাত ও মিজানকে।

নুসরাত বোনকে নায়িকা ও মডেল বানানোর রঙিন স্বপ্ন দেখিয়ে ঢাকায় নিয়ে যান। নুসরাতের সহযোগিতায় পূর্বপরিচিত জনৈক হিরু মিয়ার মাধ্যমে শোবিজ জগতে যাতায়াত শুরু হয় মুনিয়ার। তার সঙ্গে পরিচয় হয় সিনেমার বিতর্কিত প্রযোজক নজরুল রাজের। নজরুল রাজ তাকে নায়িকা বানানোর স্বপ্ন দেখিয়ে ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত ক্লাবে নিয়ে যেতে থাকেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি মুনিয়া ও নুসরাতকে। এ সময় মুনিয়া একের পর এক প্রেমিক বদল করেন। বিশেষ করে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের টার্গেট করেন। একসময় বহুল আলোচিত ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার সঙ্গেও তার পরিচয় হয়। এ সময় তার শনৈ শনৈ উন্নতি হয়। তার হাতে আসে বিপুল অর্থসম্পদ। সেই অর্থ চলে যেত নুসরাত ও মিজানের হাতে।

মুনিয়ার একমাত্র ভাই আশিকুর রহমান সবুজ বলেছিলেন, মা-বাবার মৃত্যুর পর মিজান ও নুসরাতই ছিলেন মুনিয়ার অভিভাবক। অঢেল টাকা কামানোর লোভে তারা মুনিয়ার জীবন কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তা একবার জানারও চেষ্টা করেননি। বরং ছোট বোনকে যথেচ্ছা চলাচল, যেখানে-সেখানে থাকার অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে বোন-ভগ্নিপতি হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। কেউ কেউ বলেন, মুনিয়ার ফ্ল্যাট থেকে ৫০ লাখ টাকা খোয়া যাওয়ার কথা শোনা যায়। ওই টাকাও চলে যায় নুসরাতের হাত ঘুরে মিজানের কাছে।

কুমিল্লার বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুনিয়াকে দিয়ে একসময় নুসরাত ও তার স্বামী মিজানুর রহমান একটি ব্ল্যাকমেল সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি দীর্ঘদিন থেকেই তাদের টার্গেটে ছিলেন। এ ছাড়া তৌহিদ আফ্রিদিসহ আরও অনেক তরুণ ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিকে শিকারে পরিণত করেন দুই বোন। তাদের লক্ষ্য ছিল বসুন্ধরার এমডিকে ব্ল্যাকমেল করে অর্থ আদায় করা। কিন্তু মুনিয়ার আকস্মিক মৃত্যুর পর নুসরাত ধারণা করেন, মুনিয়ার আত্মহত্যা মামলায় বসুন্ধরার এমডিকে ফাঁসানো গেলে এক লাফেই তিনি ‘বিত্তবান’ হয়ে যাবেন। আর সেই টার্গেট থেকেই তিনি গুলশান থানায় করা আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলায় বসুন্ধরার এমডিকে আসামি করেন। মামলাটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে কোনো গ্রহণযোগ্য ভিত্তি না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। এরপর কয়েকজন বিতর্কিত ব্যক্তির কুপরামর্শে নুসরাত এখন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান-এমডিসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এর আগে ২ মে নুসরাতের ভাই আশিকুর রহমান সবুজ ছোট বোনের মৃত্যুকে হত্যাকান্ড অভিযোগ করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলা করেন। ওই সময় আদালতের আদেশ ছিল, নুসরাতের মামলা তদন্ত শেষে এ মামলাটির তদন্ত শুরু হবে। ১৮ আগস্ট আত্মহত্যা প্ররোচনা মামলাটি মহানগর হাকিম আদালতে খারিজ হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই এরপর মুনিয়ার ভাইয়ের মামলাটি তদন্ত শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু ওই মামলার তদন্ত ও বিচার কাজ পরিচালনার আগেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মুনিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার মামলা করেন নুসরাত। আইনের দৃষ্টিতে এ মামলা হতে পারে কি না জানতে চাইলে আইনি ব্যাখ্যা দেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মো. আবদুল্লাহ আবু। তিনি বলেন, ‘না, এ মামলা করতেই পারে না। পূর্ববর্তী মামলায় বাদী যদি কোনো গাফিলতি হয়েছে বলে মনে করেন, তাহলে তিনি (নুসরাত) নারাজি দিতে পারেন। কিন্তু একই বিষয়ের ওপর আবারও মামলা করতে পারেন না। এভাবে মামলা হয় না, আইনে নেই।’ সিনিয়র এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় যে মামলা করা হয়েছে সেটি নিষ্পত্তির আগে একই বিষয়ের ওপর থার্ড মামলা হতে পারে না। যদি কেউ এ ধরনের মামলা করেনও, তাহলে তা খারিজ হয়ে যাবে। জুডিশিয়াল নোটিসে যখন সেই মামলা আসবে, তখন তা খারিজ হয়ে যাবে। একই বিষয়ে একাধিক মামলা চলতে পারে না। যেহেতু একই ঘটনায় হত্যা মামলা আগেই করা আছে, তিনি নারী বলে বা কারও কুমন্ত্রণায় এভাবে মামলা করবেন, এটা হতে পারে না। নারী হলেই একই বিষয়ে দুটি মামলা করবেন তা হবে না। এটা টিকবে না। কোর্ট বিষয়টি জানতে পারলে খারিজ করে দেবে। হত্যা মামলা যেহেতু হয়ে আছে, সেখানে আবার হত্যা মামলা হবে না। একই বিষয়ে একাধিক মামলা হতে পারে না। যেমন দ্বিতীয় মামলা স্টে ছিল পূর্ববর্তী মামলা পরিচালনার স্বার্থে। এখন যেহেতু প্রথম মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে তাই দ্বিতীয় মামলা চলবে। তবে দ্বিতীয় মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগে অবশ্যই থার্ড মামলা হতে পারে না। এটা বেআইনি।’ আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এতগুলো মামলা করার মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাওয়া নুসরাত ও মিজানের মূল উদ্দেশ্য নয়। তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে ব্ল্যাকমেল করা এবং ব্যবসায়ী গ্রুপকে ব্যবসায়িক ক্ষতির মধ্যে ফেলা। নুসরাত ও মুনিয়া অতীতেও অনেক ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেল করেছেন। মুনিয়াকে দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা এবং সেই সখ্যের ভিডিও ধারণ করে বা নানা কৌশলে পরে ওই সব ব্যবসায়ীকে ব্ল্যাকমেল করাই ছিল নুসরাত-মুনিয়ার কাজ। এর আগে গুলশান থানা পুলিশের তদন্তে ও মুনিয়ার সঙ্গে বিভিন্নজনের চ্যাটিংয়ের স্ক্রিনশটেও এ রকম প্রমাণ মিলেছে। মুনিয়া বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে চ্যাটিং করতেন মেসেঞ্জারের মাধ্যমে। তাদের কল রেকর্ড করতেন এবং অসতর্ক মুহুর্তগুলো মোবাইলে ধারণ করে নুসরাতের কাছে দিতেন। নুসরাত সেগুলো ব্ল্যাকমেলিংয়ের কাজে ব্যবহার করতেন। মুনিয়ার মৃত্যুর পরও তারা নতুন কৌশলে মামলা দিয়ে ব্ল্যাকমেল শুরু করেছেন।

সর্বশেষ খবর