জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ২১ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীরা সার্বক্ষণিকভাবে জনগণকে সেবা প্রদানে বাধ্য। আমি আশা করি, আপনারা এই সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগ করবেন। তিনি বলেন, আমি চাই, আপনারা সেভাবে আপনাদের কাজে নিজেদের নিবেদিত করবেন। জনসেবায় এবং নাগরিক সেবায় উদ্ভাবন এবং সেবাবান্ধব প্রশাসন গড়ে উঠুক সেটাই সবার কাম্য। প্রধানমন্ত্রী গতকাল বিসিএস প্রশাসন একাডেমির ১১৯ এবং ১২০তম আইন ও প্রশাসন প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপনী ও সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শাহবাগের বিসিএস প্রশিক্ষণ একাডেমি মিলনায়তনে মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।
জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আপনারা নিবেদিত থাকবেন, জনগণের পাশে থাকবেন। মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করবেন। তিনি বলেন, যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছি, আমার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী না, জনগণের সেবক হিসেবে দেখি। আমি মনে করি, এই দায়িত্ব আমার, জনগণের সেবা করা। আপনাদের কাছেও আমি এটা চাই, আপনারা জনগণের সেবক হিসেবেই কাজ করবেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় করোনাকালীন মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের চালু করা ভার্চুয়াল কোর্টের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষকে আইনের সেবা দেওয়া, বিচার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা খুবই প্রয়োজন, বিচারের বাণী যেন নিভৃতে না কাঁদে। কারণ, আমি তার ভুক্তভোগী। শেখ হাসিনা বলেন, ’৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার পর বিচার যাতে না হয় সেজন্য ইনডেমনিটি (অর্ডিন্যান্স জারি) দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ বিচারের হাত থেকে তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। আমাদের কোনো অধিকার ছিল না একটা মামলা করার বা বিচার চাওয়ার।
’৯৬ সালে সরকার গঠনের পর তাঁর সরকার সেই কালো আইন বাতিল করে এবং পরবর্তীতে খুনিদের বিচার সম্পন্ন এবং বিচারের রায়ও কার্যকর করতে সমর্থ হয়, বলেন তিনি। ২০৪১ সালে আমরা কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই, সেই প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়নের পর আমরা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৪১ সালের উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলায় আজকের নবীন কর্মকর্তাদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা থাকবেন সেই ’৪১-এর সৈনিক। সেভাবে আপনাদের তৈরি হতে হবে, কাজ করতে হবে। আর ২০৭১ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপন করব আমরা। সেই শতবর্ষ উদযাপনেও বাংলাদেশ কীভাবে এগিয়ে যাবে তা মাথায় রেখেই আমরা ২১০০ সাল পর্যন্ত ডেল্টা প্ল্যান করে দিয়েছি। অর্থাৎ প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন এই ব-দ্বীপ অঞ্চলের মানুষগুলো সুন্দর জীবন পেতে পারে। আমাদের মতো কষ্ট ভোগ করতে না হয় সে জন্যই আমাদের এই পরিকল্পনা, বলেন তিনি।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম বক্তৃতা করেন। প্রতিষ্ঠানের রেক্টর মোমিনুর রশিদ আমিন স্বাগত বক্তব্য দেন। ১১৯ এবং ১২০তম ব্যাচের শীর্ষ স্থান অর্জনকারী এবং রেক্টর পদকপ্রাপ্ত স্বীকৃতি প্রামাণিক ও উম্মে সালমা নাজনীন তৃষা অনুষ্ঠানে তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন শিক্ষার্থীদের হাতে সনদ এবং মেধা তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকারকারীদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গণভবন প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারি কর্মচারীদের বড় প্রণোদনা হলো তাদের পদোন্নতি। ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ে সব ব্যাচকে তাদের প্রাপ্য পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের তাদের উদ্যমী কর্মকান্ডের স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে আমরা একাধিক পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছি। জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে ‘জনপ্রশাসন পদক’ প্রদান করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেলে কর্মচারীদের উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে গৃহ-নির্মাণ ঋণ, গাড়ি কেনার ঋণ প্রদান করা হচ্ছে এবং গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক আর্থিক সুবিধা দিচ্ছি। এ ছাড়াও ঢাকা শহরসহ অন্যান্য জেলা শহরে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত নতুন আবাসন ব্যবস্থা। যাতে ভালোভাবে বসবাসের পাশাপাশি দেশের সেবায় আরও মনোযোগী হতে পারেন এবং আত্মনিয়োগ করতে পারেন।
প্রশিক্ষণকে তিনি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করে বলেন, প্রশিক্ষণের সময় কিছুটা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে এই প্রশিক্ষণকালটা আরেকটু বাড়ানোরও ইঙ্গিত দেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, একটি দেশের এগিয়ে যাওয়ার মূল চালিকাশক্তি হলো দক্ষ এবং দূরদর্শী সিভিল সার্ভিস। কারণ, আমরা নির্বাচিত হয়ে আসি পাঁচ বছরের, স্বল্প সময়ের জন্য। আপনারা দায়িত্বে থাকেন দীর্ঘ সময়ের জন্য। তাই, একটা আদর্শ নিয়ে চলতে হবে। লক্ষ্য স্থির রেখে সামনে এগোতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিসিএস প্রশাসন একাডেমিকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে এবং ১৫ তলা বহুতল ভবন নির্মাণ করে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্টাডি সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে জ্ঞানচর্চার অনুশীলন অধিকতর সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে প্রশাসনের কর্মকর্তারা যাতে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দেশেই নিতে পারেন সে বিবেচনায় আমরা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমি অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। শেখ হাসিনা মুজিববর্ষে দেশের সব গৃহহীনের জন্য বিনামূল্যে ঘর করে দেওয়ায় তাঁর সরকারের কর্মসূচি সফল করার ক্ষেত্রে সহযোগিতাকারী মাঠ প্রশাসনকে এ সময় ধন্যবাদ জানান এবং এই কর্মসূচি অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ও পুনর্ব্যক্ত করেন। দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী করোনাকালীন বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। তিনি পতিত জমি এবং ঘরের আশপাশের জমিকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব জমি রয়েছে সেগুলো কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট বা পুলিশের বা বর্ডার গার্ডের অর্থাৎ যে যেখানে কাজ করে যেখানে যতটুকু জমি রয়েছে সেখানেই প্রত্যেকের কিছু না কিছু উৎপাদন করার এবং এটা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ : রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী গতকাল সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় পৌঁছলে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং তাঁর সহধর্মিণী রাশিদা খানম ফুল দিয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানান। এ সময় প্রধানমন্ত্রীও রাষ্ট্রপতিকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।
সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে যোগদানসহ যুক্তরাষ্ট্র সফরের সার্বিক বিষয় রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেন।
তিনি সরকারের সার্বিক কর্মকান্ড, বিশেষ করে কভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং টিকা প্রদানের মাধ্যমে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গৃহীত কার্যক্রম বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেন বলে রাষ্ট্রপতির ডেপুটি প্রেস সচিব মুন্সী জালাল উদ্দিন জানান। তিনি জানান, রাষ্ট্রপতি ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে সঠিক পথে অগ্রসর রাখার স্বীকৃতি হিসেবে ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’ অর্জন করায় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এ সময় রাষ্ট্রপতি জাতিসংঘ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর সার্বিক ভূমিকার প্রশংসা করেন।
রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বলে জানান ডেপুটি প্রেস সচিব।
রাষ্ট্রপতির ছেলে সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসসহ রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।