শুক্রবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

যৌতুকলোভীরা বেপরোয়া

নববধূ থেকে সন্তানের মা কেউই রেহাই পাচ্ছেন না, দুই দশকে ৩ হাজার ৪৩৭ গৃহবধূর মৃত্যু

জিন্নাতুন নূর

যৌতুকলোভীরা বেপরোয়া

কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না যৌতুকলোভীদের। যৌতুকের লোভে স্ত্রী, সন্তান এবং স্ত্রীর পরিবারের লোকজনদের ওপরও বেপরোয়া হামলে পড়ছেন স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। যৌতুকের কারণে নববধূ থেকে শুরু করে দুই সন্তানের মা কেউই শারীরিক-মানসিক নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। পারিবারিক বিয়ে বা প্রেমের বিয়ে যা-ই হোক না কেন ভয়াবহ এই সামাজিক ব্যাধির ছোবলে একের পর এক নির্যাতিতা গৃহবধূর প্রাণ যাচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর তথ্যে, ২০০১ থেকে ২০২১ সাল (সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দুই দশকে যৌতুকের কারণে ৩ হাজার ৪৩৭ জন গৃহবধূর মৃত্যু হয়। মৃত গৃহবধূর মধ্যে ছিল ৪৮ শিশুও। সামাজিক এ ব্যাধি বন্ধে দেশে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ থাকলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘৃণ্য এ প্রথা শুধু আইন প্রয়োগে বন্ধ করা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা।

গত এক দশকে যৌতুকের কারণে ভুক্তভোগী গৃহবধূর মৃত্যু ও আত্মহত্যা কিছুটা কমলেও বর্তমান অবস্থা সন্তোষজনক নয়। ২০১০ সালে যৌতুকের কারণে নির্যাতনে ২৩৫ গৃহবধূর মৃত্যু হয়। আর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৭ নারীর মৃত্যু হয়। ২০১০ সালে একই কারণে যেখানে ২২ জন নারী আত্মহত্যা করেন, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ জন্য আত্মহত্যা করেন ছয়জন নারী। এ ছাড়া ২০১০ সালে যৌতুকের কারণে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন ১২২ জন আর ২০২১ সালে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৯৮ জন গৃহবধূ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনায় অনেক দম্পতি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আবার শিক্ষিত যে পরিবারের ছেলেরা আগে যৌতুকের জন্য তার স্ত্রীর ওপর চাপ দেওয়ার কথা ভাবতেনও না, তারাও এখন স্ত্রীকে শ্বশুরবাড়ি থেকে অর্থ এনে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। মাহমুদা খানম আঁখি (২১)। বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। তার স্বামী আনিসুল ইসলাম চট্টগ্রাম জেলা বারের অন্তর্ভুক্ত আইনজীবী। কিন্তু আইনজীবী হওয়ার পরও যৌতুক না পেয়ে আনিসুল সম্প্রতি তার স্ত্রীকে হত্যা করেন। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে এ ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত আইনজীবীকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং অভিযুক্তের মা ও বোনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। জানা যায়, দুই বছর আগে আঁখি ও আনিসুলের বিয়ে হয়। তারা চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার পাঠানিয়া গোদা এলাকার ভাড়া বাসায় থাকতেন। বিয়ের পর থেকেই আনিসুল যৌতুক দাবিসহ নানা বিষয়ে আঁখির সঙ্গে ঝগড়া করতেন এবং স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতেন। এ কাজে আনিসুলকে তার মা ফরিদা আক্তার (৫০) ও বোন হামিদা বেগম (৩৪) সহায়তা করতেন। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে সম্প্রতি যৌতুকের টাকা না পেয়ে এক গৃহবধূর মাথার চুল কেটে ও ব্লেড দিয়ে তার ভ্রু চেঁছে ফেলা হয়। ১৯ ডিসেম্বর সেই গৃহবধূকে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শাহজাদপুরের সাতবাড়িয়া গ্রামের মেহেদি হাসান সুজন এ নির্যাতন করেন। জানা যায়, তার সঙ্গে ভুক্তভোগীর ১৩ বছর আগে বিয়ে হয়। এ দম্পতির দুটি মেয়েসন্তান আছে। বিয়ের পর থেকে অভিযুক্ত যৌতুকের দাবিতে প্রায়ই ভুক্তভোগীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। এ ব্যাপারে স্থানীয়ভাবে একাধিকবার গ্রাম্য সালিশ হলেও নির্যাতন থামেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যৌতুক প্রতিরোধে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ থাকলেও নানা ফাঁকফোকর থাকায় অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে। এ আইনে যৌতুকের সংজ্ঞা নির্ধারণে বলা হয়েছে- ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ) প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তিগণের ক্ষেত্রে দেনমোহর, মোহরানা অথবা বিবাহের সময় বিবাহের পক্ষগণের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা শুভাকাক্সক্ষী কর্তৃক বিবাহের কোনো পক্ষকে প্রদত্ত উপহারসামগ্রী যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত হবে না।’ আর আইনের এ ব্যাখ্যার সুযোগে মূল্যবান অনেক সামগ্রী যৌতুকের নামে এখন দেওয়া-নেওয়া চলছে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিয়েতে যৌতুক দাবি, গ্রহণ বা প্রদানের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সহায়তা করার অপরাধে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অনেক সময় যৌতুকের অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না, যা দুঃখজনক। আবার কিছু ক্ষেত্রে নিরপরাধ ব্যক্তিদের এ মামলায় জড়ানো হচ্ছে। এর ফলে প্রকৃত মামলাগুলো গতি হারিয়ে ফেলছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর