শুক্রবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

পাসে রেকর্ড জিপিএ-৫ ছড়াছড়ি

পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলেও জেএসসির কারণে কপাল পুড়ল অনেক শিক্ষার্থীর, এসএসসিতে পাসের হার ৯৩.৫৮ শতাংশ, ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জিপিএ-৫

আকতারুজ্জামান

পাসে রেকর্ড জিপিএ-৫ ছড়াছড়ি

ফল প্রকাশের পর উচ্ছ্বাস। রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে গতকাল তোলা ছবি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

করোনা মহামারীর মধ্যে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে নেওয়া এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা-২০২১ এর ফল প্রকাশ করা হয়েছে গতকাল। ফলাফলে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২২ লাখ ৪০ হাজার ৩৯৫ ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৪৬ জন। পাসের হার ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। পাসের রেকর্ড ছাড়িয়ে এই পাবলিক পরীক্ষায় পাসের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। জিপিএ-৫ প্রাপ্তিও অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন, যা উত্তীর্ণের ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন। গত বছরের চেয়ে ৪৭ হাজার ৪৪২ জন জিপিএ-৫ বেশি পেয়েছে। মাত্র তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা নিয়ে বাকি বিষয়গুলোতে জেএসসি/জেডিসির ফল বিবেচনায় নেওয়ায় পরীক্ষায় ভালো করেও অনেক শিক্ষার্থীর ফলাফল কমে গেছে। এসএসসিতে অনুষ্ঠিত হওয়া তিনটি পরীক্ষায় কোনো কোনো শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেলেও জেএসসির খারাপ ফলাফলের কারণে তাদের কপাল পুড়েছে।

রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের অধীনে বগুড়ার রাজাপুর আনসার ও সমাজ উন্নয়ন হাই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল মোছা. জেসমিন আকতার জিম। বিজ্ঞান বিভাগে মাত্র তিনটি বিষয়ে (পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সবকটিতে পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান তিনি। কিন্তু বাকি বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা হয় জেএসসির জিপিএ অনুযায়ী। জেএসসিতে ভালো ফল না থাকায় বাকি বিষয়গুলোতেও এসএসসিতে ভালো ফল পায়নি জিম। এসএসসির ফলাফলে ২ দশমিক ৯৪ জিপিএ পেয়েছে সে। পরীক্ষায় ভালো করেও জেএসসির কারণে খারাপ রেজাল্ট পেয়ে জেসমিন আকতার জিম এখন দুঃখ ভারাক্রান্ত। গতকাল জিম এ প্রতিবেদককে জানায়, জেএসসি তো কোনো পাবলিক পরীক্ষা নয়। তাহলে জেএসসির কারণে এসএসসিতে কেন আমাকে খারাপ নম্বর দেওয়া হবে? এসএসসি পরীক্ষার ভিত্তিতে রেজাল্ট চাই আমি। নাটোরের গ্রিন একাডেমি হাই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল পার্থ প্রতীম সান্যাল। সে মানবিক বিভাগ থেকে ইতিহাস ও বিশ্ব সভ্যতা, ভূগোল ও পরিবেশ এবং অর্থনীতি বিষয়ে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। ফলাফলে সবকটিতে জিপিএ-৫ পেলেও জেএসসিতে কম ফলাফলের কারণে এসএসসিতে তার জিপিএ এসেছে ৪ দশমিক ৭৩। সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জেএসসিতে খারাপ করা ছাত্র-ছাত্রীদের এসএসসিতে ফলাফল খারাপ এসেছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এসএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তিনি নতুন বছরের পাঠ্যবই বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এখানে শিক্ষার্থীদের হাতে বই বিতরণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর বেলা ১১টায় এ সম্মেলন কেন্দ্রে সংবাদ সম্মেলন করে এসএসসি ও সমমানের ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত বছর এসএসসিতে ২০ লাখ ৪০ হাজার ২৮ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাস বেড়েছে ৪ লাখ ৬ হাজার ২৩টি। পাসের হার বেড়েছে ১০ দশমিক ৭১ শতাংশ। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে এ বছর পরীক্ষা হয়েছে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। তিন ঘণ্টার পরিবর্তে পরীক্ষা হয়েছে দেড় ঘণ্টায়। কেবল তিনটি নৈর্ব্যচনিক বিষয়ের পরীক্ষায় বসতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। বাংলা, ইংরেজি, গণিতসহ আবশ্যিক বিষয়গুলোতে এবার পরীক্ষা না নিয়ে জেএসসি-জেডিসির পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়েছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, আবশ্যিক বিষয়গুলোতে পরীক্ষা নেওয়া হয়নি এবার। পরীক্ষার্থীরা জেএসসিতে যে নম্বর পেয়েছিল এসএসসিতে সেই নম্বরই দেওয়া হয়েছে। ফলাফলের ক্ষেত্রে এভাবেই সাবজেক্ট ম্যাপিং করা হয়েছে।

এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গতকাল সকাল থেকেই ফলপ্রত্যাশী ও অভিভাবকদের ভিড় বাড়তে থাকে। আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই হৈ-হুল্লোড়ে আর উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে ছাত্র-ছাত্রীরা। ডেমরার সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় এবার শতভাগ পাসসহ ৯৩৯ জন ছাত্র-ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১ হাজার ৫০ জনে ৮২৭, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ২২৬ জনে ৭৮ ও মানবিক বিজ্ঞান থেকে ৯৬ জনে ৩৪ জন এ প্লাস পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মো. মাহবুবুর রহমান মোল্লা বলেন, এমন ফলাফলের জন্য সব পরীক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ধন্যবাদ জানাই। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২ হাজার ৬২৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাসের হার ৯৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ হাজার ৯৬৫ জন শিক্ষার্থী। ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১ হাজার ৯৬৩ পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ হাজার ৬৩৩ জন। মাইলস্টোন কলেজ থেকে মোট ১ হাজার ৬৩১ জন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে শতভাগ পাস করেছে। এদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯৯৭ জন শিক্ষার্থী। মণিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে তাফসিয়া তাহের মীম। গতকাল তিনি বলেন, ফল নিয়ে টেনশনে ছিলাম। এখন ভালো লাগছে। সব পরীক্ষা দিতে পারলে আরও ভালো লাগত। ভালো ফলাফলের জন্য বাবা-মা-শিক্ষক সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

পাসে সেরা ময়মনসিংহ, পিছিয়ে বরিশাল : এসএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হারে শীর্ষ অবস্থান দখল করেছে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডে গড় পাসের হার ৯৭ দশমিক ৫২। অন্যদিকে পাসের হারে পিছিয়ে আছে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডে পাসের হার ৯০ দশমিক ১৯। এ ছাড়া ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ৯৩ দশমিক ১৫ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে ৯৪ দশমিক ৭১, কুমিল্লা বোর্ডে ৯৬ দশমিক ২৭, যশোরে ৯৩ দশমিক শূন্য ৯, চট্টগ্রামে ৯১ দশমিক ১২, সিলেটে ৯৬ দশমিক ৭৮, দিনাজপুর বোর্ডে ৯৪ দশমিক ৮, মাদরাসা বোর্ডে ৯৩ দশমিক ২২ শতাংশ এবং কারিগরি বোর্ডে ৮৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।

১৮ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবাই ফেল : চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সারা দেশের ১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করতে পারেনি। আর ৫ হাজার ৪৯৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবাই পাস করেছে।

পাসের হার জিপিএ- এগিয়ে মেয়েরা : চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার এবং জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে মেয়েরা। মেয়েদের পাসের হার ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ছেলেদের পাসের হার ৯২ দশমিক ৬৯। অন্যদিকে মোট জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী রয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৫৭৮ জন এবং ছাত্র রয়েছে ৭৯ হাজার ৭৬২ জন।

এগিয়ে বিজ্ঞান বিভাগ : ৯টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পাসের হারে এগিয়ে রয়েছে বিজ্ঞান বিভাগ। বিজ্ঞান বিভাগে ৯৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৯৩ দশমিক ৫১ শতাংশ ও মানবিক বিভাগে ৯৩ দশমিক ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।

বিদেশ কেন্দ্রে পাস ৯৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ : এ বছর দেশের বাইরের নয়টি কেন্দ্র থেকে ৪১৬ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। এদের মধ্যে ৩৯৮ জন পাস করেছে। পাসের হার ৯৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। চারটি কেন্দ্রে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে।

ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন জানুয়ারি পর্যন্ত : আজ ৩১ ডিসেম্বর থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত এসএসসি ও সমমানের ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করা যাবে। টেলিটক মোবাইল অপারেটর থেকে মেসেজ অপশনে গিয়ে জঝঈ লিখে স্পেস দিয়ে বোর্ডের নামের প্রথম তিন অক্ষর লিখে স্পেস দিয়ে রোল নম্বর লিখে স্পেস দিয়ে বিষয় কোড লিখে ১৬২২২ নম্বরে পাঠাতে হবে।

সর্বশেষ খবর