মঙ্গলবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

সার্চ কমিটি রেখেই ইসি গঠনের আইন হচ্ছে

মন্ত্রিসভায় খসড়া অনুমোদন

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাধীনতার ৫০ বছর পর নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন করতে যাচ্ছে সরকার। এ সংক্রান্ত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’-এর খসড়া গতকাল চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রস্তাবিত আইনে অনুসন্ধান (সার্চ) কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার-সিইসি ও কমিশনার নিয়োগের কথা বলা হয়েছে।

গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে  এ অনুমোদনের কথা জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। এটি এখন আইন মন্ত্রণালয় হয়ে এ সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে যাবে। পরে জাতীয় সংসদে আইন আকারে পাস হলে তা কার্যকর হবে।

সংবিধানের ১১৮(১) ধারায় বলা হয়েছে- ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন।’ কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো সরকার এ আইন প্রণয়ন করেনি। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সংবিধানের ১১৮(১)-এ বিধান আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে পারেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ আইনটি নিয়ে আসা হয়েছে। খুব বেশি বড় আইন না এটি। এ জাতীয় আইন যেহেতু আমরা হ্যান্ডেল করে আসছি, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন আছে, মোটামুটি সেই অনুযায়ী এটা করা হয়েছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার কারা হতে পারবেন আর কারা হতে পারবেন না তা খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যোগ্যতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। বয়স কমপক্ষে ৫০ বছর হতে হবে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধা-সরকারি বা বেসরকারি বা বিচারবিভাগীয় পদে কমপক্ষে ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তাহলে কেউ প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন।

অযোগ্যতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, আদালতের মাধ্যমে কেউ অপ্রকৃতস্থ হিসেবে ঘোষিত হন, দেউলিয়া ঘোষণার পর দেউলিয়া অবস্থা থেকে মুক্ত না হলে, অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেন বা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন, নৈতিক স্খলন এবং সেক্ষেত্রে যদি ফৌজদারি অপরাধে কমপক্ষে দু-বছর কারাদন্ডে দন্ডিত হন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রায়ে দন্ডিত হলে, রাষ্ট্রীয় পদে থাকলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার হতে পারবেন না।

আগামী নির্বাচন কমিশন এ আইনের অধীনে হবে কি না জানতে চাইলে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, যদি এর মধ্যে হয়ে যায় তাহলে হবে। আজকে অনুমোদন দেওয়া হলো, হয়তো কাল-পরশু দুই দিন লাগবে আইন মন্ত্রণালয়ের। তারপর যদি উনারা সংসদে পাঠান, সংসদেও তো কয়েক দিন লাগবে। স্ট্যান্ডিং কমিটিতে যাবে, উনারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। যদি হয় তো হয়ে যাবে, অসুবিধা তো নেই। আইনটি চূড়ান্ত করতে আমরা আশা করছি খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়, ছোট আইন। আইনের জন্য বিস্তারিত উল্লেখ করে একটি বিধি করে দেওয়া হবে। যাতে প্রক্রিয়াগত বিষয়ে বারবার আইন সংশোধন করতে না হয়।

সার্চ কমিটির বিষয়ে আইনে কী বলা হয়েছে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সার্চ কমিটিতে এক নম্বরে থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, তিনি কমিটির চেয়ারম্যান হবেন। এরপর থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, কম্পট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, পিএসসির চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কমিটিতে সাচিবিক সহায়তা দেবে। এ সার্চ কমিটি ছয় সদস্যবিশিষ্ট। কিন্তু আগের অনুসন্ধান কমিটিগুলো ছিল বিজোড় সংখ্যার। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এটা আমরা আইন মন্ত্রণালয়কে বলব কমিটির সদস্য সংখ্যা জোড় রাখা হবে, নাকি বিজোড় রাখলে সুবিধা হবে। কোনো বিষয়ে মত দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনজন হলে তো সমস্যা হয়ে যাবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও বলেন, এর আগে যেসব নির্বাচন কমিশন হয়েছে সেগুলোকে হেফাজত দেওয়া হয়েছে এ আইনে। যেহেতু এর আগে আইন ছিল না, তাই রাষ্ট্রপতি যেসব নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন তা এ আইনের অধীনে করেছেন বলে ধরে সেগুলোকে হেফাজত করা হয়েছে। 

আইন ভাঙলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ কীভাবে হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার তো যতদূর মনে পড়ে, যেভাবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা অপসারণ হন, একই পদ্ধতি প্রযোজ্য হবে। বাকিগুলো হয়তো বিধিতে উল্লেখ করে দেওয়া হবে।

রাজাকার স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা করতে আইন আসছে : রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধিতাকারীদের তালিকা করতে আইন আসছে। এদের তালিকা তৈরি করে গেজেট প্রকাশের জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে (জামুকা) সরকারের কাছে সুপারিশ করার ক্ষমতা দিয়ে নতুন ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন-২০২২-এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

এ আইন কার্যকর হলে মুক্তিযুদ্ধ না করেও যারা অসত্য তথ্য দিয়ে গেজেটভুক্ত ও সনদপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান থাকবেন। সচিব ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে থাকবেন। কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা নয়জনের পরিবর্তে ১১ জন করা হচ্ছে। কাউন্সিলের মহাপরিচালক যিনি থাকবেন তিনি সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করবেন। অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে গেজেটভুক্ত ও সনদপ্রাপ্ত অমুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং ’৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসেবে কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিলেন বা আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন বা খুন, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগসহ অন্যান্য অপরাধমূলক ঘৃণ্য কার্যকলাপ দিয়ে মানুষ হত্যা বা তাদের অত্যাচার করেছেন, পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছেন তাদের তালিকা তৈরি করে গেজেট প্রকাশের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। রেজিস্ট্রার সংগঠনের নিবন্ধন দেবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হলে সে সংগঠনের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। আগে কাউন্সিল নিবন্ধন করত। এখন রেজিস্ট্রার নিবন্ধন দেবে।

বৈঠকে বাংলাদেশ গ্যাস, তেল ও খনিজসম্পদ করপোরেশন আইন, বৈষম্যবিরোধী আইন এবং জাতীয় লবণ নীতিমালার অনুমোদন দেওয়া হয়।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিকারে বৈষম্যবিরোধী আইন-২০২২ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আন্তর্জাতিক কনভেনশনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে সব রকমের বৈষম্য নিরসন করা হয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে এ আইন নিয়ে আসা হয়েছে। আইনের আলোকে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হবে।

পেট্রোবাংলা আইন সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ১৯৮৬ সালের অধ্যাদেশ দিয়ে এতদিন চলছিল। সামরিক শাসনামলে প্রণীত অধ্যাদেশগুলোকে আইনে রূপান্তরের বাধ্যবাধকতা থাকায় এটিকে আইনে রূপান্তর করা হচ্ছে। এটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবেই থাকবে। তাদের বাংলাদেশ গ্যাস, তেল ও খনিজসম্পদ করপোরেশন হিসেবে নামকরণ করা হবে। ‘জাতীয় লবণ নীতিমালা-২০২২ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন লবণ চাষের ক্ষেত্রে দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে উপকূলীয় জেলাগুলোর অনেকগুলোয় চিরাচরিত পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে, সেটার আধুনিকায়ন দরকার। মাতারবাড়ি, কক্সবাজার, পায়রায় কিছু জায়গায় উন্নয়ন কাজে নিয়েছি। সে জন্য নতুন নতুন জায়গায় উদ্ভাবন করা এবং নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে আরও কার্যকরী উৎপাদন এবং বড় করার জন্য নীতিমালা নেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্যবিধি না মানলে এবং মাস্ক না পরলে ১-২ দিন অবজার্ব করে অ্যাকশনে যাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের বুস্টার ডোজ নেওয়ার বয়স ৫০ বছরে নামিয়ে আনা হয়েছে। আমরা সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাব, তারা যেন একটু সচেষ্ট হয়। লাস্ট যেটা স্টাডি করেছে আইইডিসিআর, সেটাতে ৮৭ শতাংশ ছিল ডেল্টা আর ১৩ শতাংশ ছিল ওমিক্রন। এখন হয়তো ওমিক্রন একটু বেড়ে ১৮ থেকে ২০ শতাংশে এসেছে। একটা মেজর কোয়েশ্চন কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট।

সর্বশেষ খবর