স্থানীয় উৎপাদন উৎসাহিত করে আমদানি নিরুৎসাহ করতে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পণ্যের ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। বাজেটে স্থানীয় শিল্পে করছাড়সহ নানা নীতিসহায়তা দেওয়া হয়েছে। শিল্প, সেবা, কৃষি খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করছাড় দেওয়া হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু বিটুমিন শিল্প। সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের অন্যতম উপকরণ বিটুমিন শিল্প কর বৈষম্যের শিকার।
উদ্যোক্তারা জানান, বিপুল বিনিয়োগে গড়ে ওঠা দেশি বিটুমিন শিল্পে উৎপাদন পর্যায়ে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত কর ধার্য আছে। কিন্তু আমদানির ক্ষেত্রে কর কম। দেশে বিটুমিনের কাঁচামাল আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। কিন্তু পরিশোধিত বিটুমিন আমদানিতে কোনো ভ্যাট নেই। আমদানি করা বিটুমিনের সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট মাত্র ৫ শতাংশ। আর দেশে উৎপাদিত বিটুমিনে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। এ বৈষম্যমূলক করকাঠামো শিল্পসহায়ক নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে অন্যান্য পণ্য উৎপাদনে যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে বিটুমিন উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সেসব সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত সরকারের। বাজারে অসম প্রতিযোগিতা থাকলে দেশি বিটুমিন উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারবে না।’বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘দেশি শিল্প সুরক্ষার স্বার্থে কোনোভাবেই বৈষম্যমূলক করকাঠামো দেখতে চাই না। যেখানে তৈরি পণ্য আমদানিতে ভ্যাট নেই সেখানে দেশি শিল্পের উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট অযৌক্তিক ও অন্যায়। দেশি বিটুমিন সরবরাহ পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাটও অপ্রত্যাশিত।’ দেশি বিটুমিন শিল্পের সুরক্ষায় যৌক্তিক কর নির্ধারণের পরামর্শ দেন তিনি।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক খান মাহমুদ আমানত বলেন, ‘যত দিন আমদানি নিরুৎসাহ করতে সরকার কঠোর নীতিমালা না করবে তত দিন বিদেশ থেকে নিম্নমানের বিটুমিন আমদানির সুযোগ থাকবে। দেশি শিল্পকে উৎসাহিত করবে নাকি আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতেই থাকবে তা সরকারকেই ঠিক করতে হবে।’ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘আমদানির চেয়ে দেশি শিল্পকারখানায় উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাড়তি কর আরোপ হবে দেশি শিল্পের স্বার্থবিরোধী। সরকারের দেশি শিল্প সুরক্ষা নীতিরও পরিপন্থী। বৈষম্যমূলক এ করকাঠামো সংশোধন করা উচিত।’
বন্দরসংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, আমদানি পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি ও তদারকি না থাকায় নিম্নমানের বিটুমিন আনা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে। আর অধিক মুনাফার আশায় কিছু সংস্থা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করছে। এর খেসারত গুনতে হচ্ছে সরকার ও জনগণকে।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে দেশে বিটুমিনের বার্ষিক চাহিদা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টন। অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতি বছরই চাহিদা বাড়ছে। স্থানীয়ভাবে বিটুমিন উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল পেট্রোলিয়াম অয়েলস অ্যান্ড অয়েলস অবটেইন্ড মিনারেলস, ক্রুড। এ কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কর ৫ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, আগাম কর ৩ শতাংশ এবং অগ্রিম আয়কর ২ শতাংশ। ৫ শতাংশ সিডিসহ মোট আমদানি শুল্ক দাঁড়িয়েছে ২৬ শতাংশ। এ ছাড়া প্রতি ব্যারেলের ট্যারিফ মূল্য ৪০ মার্কিন ডলার।
অন্যদিকে তৈরি বিটুমিন আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি টনের শুল্ক কর নির্ধারিত রয়েছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। এর সঙ্গে অগ্রিম আয়কর ২ শতাংশ এবং আগাম কর ৫ শতাংশ। কেউ বাল্ক আকারে আমদানি করলে প্রতি টনে ৩ হাজার ৫০০ টাকা আমদানি শুল্ক নির্ধারিত রয়েছে। এর সঙ্গে এআইটি ২ শতাংশ এবং এটি ৩ শতাংশ। এ অবস্থায় কাঁচামাল আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ৫ শতাংশ শুল্ক কর মওকুফ চান বিটুমিন উৎপাদকরা। তাঁরা বলছেন, দেশে এ খাতে বিনিয়োগের ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। একই সঙ্গে বিদেশে বিটুমিন রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ আছে। এখন দরকার যথাযথ নীতিসহায়তা ও যৌক্তিক করকাঠামো। পাশের ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশ তাদের স্থানীয় শিল্পের প্রতিরক্ষণার্থে শিল্পের মূল কাঁচামালের ওপর থেকে শুল্ক ও অন্যান্য কর প্রত্যাহার করে সংশ্লিষ্ট শিল্পের সুষ্ঠু বিকাশের স্বার্থে ফিনিশড পণ্যের ওপর বিভিন্ন রকমের শুল্ক ও অন্যান্য কর আরোপ করেছে।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক হাসিব মোহাম্মদ আহসান বলেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠান দেশে বিটুমিন উৎপাদন করতে চাইলে তাদের স্বাগত জানানো উচিত। দেশে একটা শিল্প হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। দেশে উৎপাদন হলে বিটুমিনের মান নিয়ন্ত্রণ দেশেই করতে পারব আমরা।’