তৃণমূলে আওয়ামী লীগের উৎসবমুখর সম্মেলনে ছেদ পড়ছে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে। সংঘাত-সংঘর্ষের মূলে দলীয় পদপদবি। সম্প্রতি সারা দেশে পুরোদমে ঘর গোছানো কার্যক্রম শুরু হওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ ও প্রাণহানি ঘটেছে। এসব হামলা-সংঘর্ষে যেমন দলীয় নেতা-কর্মীরা আহত-নিহত হচ্ছেন, তেমনি মামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনেকেই। এসব কোন্দলে হাওয়া দিচ্ছেন মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালীরা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগমুহূর্তে তৃণমূলের অস্থিরতায় দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে কেন্দ্রে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সারা দেশে উৎসবমুখর পরিবেশে সম্মেলন হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যারা বিশৃঙ্খলা করবে তাদের সাংগঠনিক শাস্তি পেতে হবে।’
জাতীয় নির্বাচনের আগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল কোনো প্রভাব ফেলবে কি না জানতে চাইলে দলের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সম্মেলনে সবখানে সংঘাত-সংঘর্ষ হচ্ছে এমন নয়। বিচ্ছিন্ন দু-একটি উপজেলার ঘটনা জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। ভোটের সময় আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মী এক হবেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় প্রতিটি সংসদীয় আসনে অভ্যন্তরীণ কোন্দল দানা বেঁধে উঠেছে। এর নেতৃত্বে মন্ত্রী-এমপি এবং একটি সুবিধাভোগী শ্রেণির লোক। জেলা-উপজেলার সার্বিক বিষয়ে দলীয় সভানেত্রীর কাছে রিপোর্ট জমা দেওয়া আছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের কোন্দল নিরসনের জন্য তাগাদা দিয়েছেন তিনি। আর দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারাও জেলা-উপজেলার নেতা এবং মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ে বৈঠক করছেন। দূরত্ব কমাতে কাজ করছেন। জানা গেছে, ২১ মার্চ রাজশাহীর বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই সংঘর্ষে জড়ান স্থানীয় নেতারা। মঞ্চের ওপর চেয়ার ছুড়ে মারা, ভাঙচুর, দেশি অস্ত্র, বাঁশের লাঠি ব্যবহার করা হয়। শাহদৌলা সরকারি কলেজ মাঠে উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও বাঘা পৌরসভার সাবেক মেয়র আক্কাস আলীর সমর্থকরা মঞ্চের সামনে ‘আক্কাস ভাই, আক্কাস ভাই’ বলে স্লোগান দেন। তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন স্থানীয় এমপি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সমর্থকরা। এতে কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই দুই পক্ষের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। এ ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। দুই মামলায় ৮২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৭০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই দুই ভাগে বিভক্ত বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগ। এর এক পক্ষে নেতৃত্ব দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। অন্য পক্ষে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও বাঘা পৌরসভার সাবেক মেয়র আক্কাছ আলী। তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেই সম্মেলনস্থলে সংঘর্ষ ঘটে। বেশ কিছুদিন ধরে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি জাহিদ হোসেন জাফর গ্রুপের সঙ্গে কুমারখালীর পান্টি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামিউর রহমান সুমন গ্রুপের বিরোধ চলে আসছিল। রবিবার পান্টির ডাঁসা মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সুমন গ্রুপের প্যানেল জয়লাভ করে। এ নিয়ে সুমন গ্রুপের সমর্থক গোলাম নবী সোমবার সকালে সান্দিয়ারা বাজারে জাহিদ হোসেন জাফর গ্রুপের সমর্থক শরীফুল ইসলামকে কটূক্তি করেন। এ সময় বিক্ষুব্ধ মামুনের সমর্থকরা গোলাম নবীকে পিটিয়ে আহত করেন। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় মসজিদের মাইকে ‘ইজ্জতের লড়াই’ ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষে জড়ানো হয়। এতে উভয় পক্ষের প্রায় ৩০ জন আহত হন। জানা গেছে, কুমারখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গ্রুপিং এখন প্রকাশ্যে। এর এক পক্ষের নেতৃত্ব দেন কুষ্টিয়া-৪ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ। অন্য পক্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান খান। ১৩ মার্চ পটুয়াখালীর রাঙাবালী উপজেলার মৌডুবি ইউনিয়নের সম্মেলন কেন্দ্র করে দেশি অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ কর্মী-সমর্থক আহত হন। ১৯ ফেব্রুয়ারি নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন কেন্দ্র করে নাটোর সার্কিট হাউসে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষ ঘটে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হন। জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল ও যুগ্মসাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম রমজান গ্রুপের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে নাটোর পৌর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান চুন্নু, প্রচার সম্পাদক মশিউর রহমান, পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মীর নাফিউল ইসলাম অন্তরসহ দুই গ্রুপের অন্তত ১০ জন আহত হন। ৫ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে যমুনায় বালুঘাট দখল নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষ ঘটে। এতে উভয় পক্ষের ১৫-২০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। উপজেলার নিকরাইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মুহাম্মদ আবদুল মতিন সরকার ও নিকরাইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাবেক সাধারণ সম্পাদক নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মাসুদুল হক মাসুদ গ্রুপের মধ্যে এ সংঘর্ষ ঘটে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও মহান শহীদ দিবসে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া কেন্দ্র করে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হন অন্তত ১০ জন। স্থানীয় আওয়ামী লীগসূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই দুই ভাগে বিভক্ত পাকুন্দিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। এক পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দিন এবং অন্য পক্ষে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম রেণু। এ বিষয়ে রফিকুল ইসলাম রেণু বলেন, ‘সোহরাব সাহেব পূর্বপরিকল্পিতভাবে তার লোকজন নিয়ে দেশি অস্ত্রশস্ত্র এনে প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘরে হামলা করেছেন।’ যদিও এমন অভিযোগ মানতে নারাজ সাবেক সাংসদ সোহরাব উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমরা শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়েছিলাম। মারামারির জন্য নয়। এমন অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই।’ ৩১ জানুয়ারি আধিপত্য বিস্তার ও গ্রামে ফেরাকে কেন্দ্র করে নরসিংদীর রায়পুরার বাঁশগাড়ী ও মির্জাচরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুজন নিহত হন। আহত হন ১০ জন। নিহতরা হলেন মির্জাচরের বাবুল মিয়ার ছেলে মামুন ও মানিক মিয়ার ছেলে রুবেল মিয়া (৩২)।