রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

টেলিটকের দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ

আর্থিক লেনদেনে শর্ত ভেঙে কাজ দেওয়ার অভিযোগ অনিয়মে বাধা দেওয়ায় মূল্যায়ন কমিটি পরিবর্তন কমিটি হলেও অজ্ঞাত কারণে হয়নি তদন্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল অপারেটর কোম্পানি টেলিটকের বিরুদ্ধে যেন অভিযোগের শেষ নেই। প্রতিষ্ঠানটির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় যোগসাজশ থেকে শুরু করে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বিভিন্ন দরপত্রে অনিয়ম, মোবাইল টাওয়ার ভাড়ার নামে কোটি কোটি টাকা লোপাটসহ নানা অভিযোগ উঠছে। অনিয়মের কারণে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না কোম্পানিটি। এ নিয়ে একের পর এক তদন্ত কমিটি গঠন হলেও নেওয়া হচ্ছে না কার্যকর ব্যবস্থা। সম্প্রতি ‘সিলেকশন অব কনট্রাক্টর ফর প্রোভাইডিং সিকিউরিটি অ্যান্ড লজিস্টিক সার্ভিস টু টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড’ শীর্ষক দরপত্রে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়াতেই ‘পাহাড়সম’ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের প্রভাব খাটিয়ে দেড় কোটি টাকা অনৈতিক লেনদেনে নিয়ম ভেঙে ‘বিতর্কিত’ আল আরাফাত সার্ভিসেস (প্রা.) লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিকে কাজটি দেওয়ার অভিযোগ করেছে যমুনা স্টার সেফ গার্ড লিমিটেড ও স্কলাস্টিকা সিকিউরিটিস কোম্পানি। মন্ত্রণালয়ে দেওয়া প্রতিষ্ঠান দুটির অভিযোগ অনুযায়ী, টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাহাব উদ্দিন টাকার বিনিময়ে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে সিপিটিইউ স্ট্যান্ডার্ড ডকুমেন্ট পাশ কাটিয়ে ওই কোম্পানির অভিজ্ঞতার আলোকে দরপত্রে মানদন্ড নির্ধারণ করায় অনেক কোম্পানি প্রতিযোগিতায় অংশই নিতে পারেনি। এ ছাড়া দরপত্রের মূল শর্তের জিসিসি, ২০ (ক) মতে, কলকারখানা অধিদফতরের হালনাগাদ ঠিকাদারি লাইসেন্স বাধ্যতামূলক হলেও আল আরাফাত সার্ভিসেস (প্রা.) লিমিটেডের তা ছিল না। তবুও প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দিতে দুইবার দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং মূল্যায়ন কমিটি পরিবর্তন করা হয়। কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবু তালেব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকাকালে ফেনীতে তার গাড়িবহরে বোমা হামলা মামলাসহ সরকারবিরোধী জ্বালাও-পোড়াও ও অগ্নিসংযোগ সংক্রান্ত ১২টি মামলার আসামি বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। প্রতিষ্ঠান দুটির অভিযোগের প্রেক্ষিতে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে গত ৬ ফেব্রুয়ারি দুই সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে অজ্ঞাত কারণে মাস পার হলেও তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই। এদিকে তদন্ত চলাকালেই আল আরাফাত সার্ভিসেস (প্রা.) লিমিটেডকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কাজ করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তদন্তের অগ্রগতি জানতে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের যুগ্মসচিব (টেলিকম) খোন্দকার মো.  আবদুল হাইয়ের মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি ফোনকল কেটে দেন। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তদন্ত কমিটির অপর সদস্য টেলিযোগাযোগ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। আমি বাইরের সদস্য। আমাকে এখনো ডাকেনি। না ডাকলে আমি কীভাবে যাব?

এদিকে টাকার ভাগাভাগি ও কাজটি দেওয়া নিয়ে সংশ্লিষ্টদের  বৈঠকের একটি অডিও ক্লিপ বাংলাদেশ প্রতিদিনের হাতে এসে পৌঁছেছে। সেই রেকর্ড বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অনিয়মের কারণে গঠিত তদন্ত কমিটি যেন কোনোভাবেই টেলিটকে আসতে না পারে তার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এই কাজটি নিয়ে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঝামেলায় আছেন বলেও শোনা যায়। টাকা দিয়ে সিপিটিইউ-সহ বিভিন্ন জায়গা ম্যানেজ করা ও ভালো আইনজীবী রাখার বিষয়ে ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। এমনকি আওয়ামী লীগের এক সিনিয়র নেতাকে দিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীকে ফোন দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে জানতে ওয়েবসাইটে দেওয়া টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহাব উদ্দিনের টেলিটক নম্বরে ফোন দিলে নম্বরটি আর ব্যবহার হচ্ছে না বলে অপারেটর থেকে জানানো হয়। পরে তার দফতরের টেলিফোনে কল করলে কেউ রিসিভ করেননি। জানা গেছে, টেলিটক গত বছরের ২৩ জুন  ‘সিলেকশন  অব  কনট্রাক্টর  ফর  প্রোভাইডিং সিকিউরিটি অ্যান্ড লজিস্টিক সার্ভিস টু টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে একটি দরপত্র আহ্বান করে। সেই  আহ্বানে আল আরাফাত সার্ভিসেস (প্রা.) লিমিটেড, কৃষ্ণা সিকিউরিটি সার্ভিস লিমিটেড, সিকিউরিটাস সিকিউরিটি অ্যান্ড লজিস্টিক সার্ভিসেস লিমিটেড ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিসেস লিমিটেড অংশ নেয়। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের দেওয়া তথ্য মতে, একমাত্র কৃষ্ণা সিকিউরিটি সার্ভিস ছাড়া বাকি তিনটি প্রতিষ্ঠানেরই লাইসেন্সের মেয়াদ ছিল না। অথচ, শর্তানুযায়ী দরপত্রে অংশ নিতে ঠিকাদারি সংস্থার কলকারখানা অধিদফতর থেকে হালনাগাদ লাইসেন্স থাকতে হবে। এ ব্যাপারে টেলিটকের অ্যাডমিন বিভাগের ডিজিএম ও মূল্যায়ন কমিটি সদস্য সচিব কামরুজ্জামান বলেন, দরপত্রে অনিয়মের যে অভিযোগ, তার কোনো প্রমাণ নেই। দরপত্র দাখিলের সময় কোনো কোম্পানি লাইসেন্স নবায়নের কপি দিতে পারেনি। তবে নবায়নের আবেদন কপি জমা দিয়েছে। নবায়ন হতে তিন-চার মাস সময় লাগে। টেন্ডার তো বন্ধ রাখা যাবে না। লাইসেন্সের পেছনে লেখা থাকে নবায়ন ফি জমা দিলে এক বছর মেয়াদ ধরা যায়। এ ছাড়া যারা অভিযোগ করেছে তারা তো দরপত্রে অংশই নেয়নি। প্রি-বিড মিটিংয়েও ছিল না। যারা অংশ নিয়েছে তারা কেউ অভিযোগ দেয়নি। মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি করেছে। সেই কমিটি এখনো আসেনি। তারা আসলে দেখবে সব ঠিক আছে কি না। এদিকে কোনো প্রতিষ্ঠান নবায়নের আবেদন করেই নবায়ণকৃত ভাবার সুযোগ আছে কি না- এ ব্যাপারে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের কাছে লিখিতভাবে জানতে চাওয়া হলে তারা জানান, কেবল নবায়নের আবেদন করলেই নবায়ন হয়েছে এটা ভাবার সুযোগ নেই। নবায়নকৃত লাইসেন্সের কপি হাতে পাওয়ার পরই লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে মর্মে গণ্য হবে। অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত চলাকালীন একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে টেলিটকের প্রকিউরমেন্ট বিভাগের ডিজিএম শরীফুল ইসলাম বলেন, যে কোনো বড় কাজ অনুমোদনের জন্য বোর্ডে যায়। বোর্ডের চেয়ারম্যান সচিব সাহেব। বোর্ডের সিদ্ধান্ত আমরা বাস্তবায়ন করি। কাজ দেওয়া টেলিটকের এখতিয়ারভুক্ত না। অভিযোগ সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রথমবার দরপত্র জমা হওয়ার পর টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওই কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার চেষ্টা করলে মূল্যায়ন কমিটির বাধায় পারেননি। পরবর্তীতে পুনঃ টেন্ডার করে তিনি মূল্যায়ন কমিটি পরিবর্তন করেন। অথচ পিপিআর মতে, মূল্যায়ন কমিটির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপিত না হলে পুনঃদরপত্রের ক্ষেত্রেও ওই মূল্যায়ন কমিটি বহাল থাকবে।

সর্বশেষ খবর