হবিগঞ্জের সাজানুর রহমান। ইতালির উদ্দেশে দেড় বছর আগে বাংলাদেশ থেকে রওনা হন। নানান পথে গিয়ে পৌঁছান লিবিয়া। তারপর শুরু অপেক্ষার পালা। একপর্যায়ে গ্রেফতার হন লিবিয়ার পুলিশে। খাটেন জেল। বাড়ি থেকে ইতোমধ্যে খরচ করেছেন ৭ লাখ টাকা। পরে আসে সাজানুরের সেই মরণযাত্রা বা ইতালির উদ্দেশে নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার দিন, যাকে লিবিয়ার দালালরা বলেন ‘গেম’। গেমে যোগ দেওয়ার পর সাজানুর স্বপ্ন পূরণের আশা করেছিলেন। কিন্তু তা নয়, শুরু হয় তার ওপর আরেক নির্যাতনের অধ্যায়।
সাজানুর রহমানের ভাই অছিউর রহমান জানান, কয়েকদিন আগে লিবিয়া উপকূল থেকে প্রায় ৫০০ জনকে নিয়ে একটি নৌকা ইতালির উদ্দেশে রওনা হয়। এদের বেশির ভাগ ছিলেন বাংলাদেশি। পরে একদল দুর্বৃত্ত তাদের সবাইকে জিম্মি করে ব্যাপক মারধর করে। মুক্তিপণের জন্য বাড়িতে খবর পাঠায়। রক্তাক্ত অবস্থায় দেশে পরিবারের সঙ্গে কথা বলানো হয়। এমন অবস্থায়ই দিনের পর দিন সাগরে ভাসতে থাকেন তারা।
শুধু সাজানুর একা নন, জিম্মি হওয়ায় সে নৌকায় একই পরিস্থিতিতে পড়েছেন হবিগঞ্জের উজ্জ্বল মিয়া, নাসির মিয়া, আফজালসহ আরও কমপক্ষে নয়জন। এ দলে আছেন মাদারীপুরেরও বেশ কয়েকজন। স্বজনদের বিপদের ভয়ে দেশে থাকা পরিবারের সদস্যরা নাম প্রকাশও করতে চান না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদারীপুরের একজনের স্বজন জানান, লিবিয়ায় থাকতে আরেকবার এমন মুক্তিপণ দিতে হয়েছিল। বাংলাদেশে প্রশাসনকে জানানোয় কয়েকদিন একেবারেই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে মুক্তিপণের দাবিও বেড়ে যায়। তার এখন পর্যন্ত ১১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান। গত বুধবার পর্যন্ত এ নৌকায় তারা ভাসমান অবস্থাতেই ছিলেন। সর্বশেষ পরিস্থিতি জানা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলারই ২৪ জন রওনা দিয়েছিলেন ইউরোপ যাওয়ার জন্য। এক বছর ধরে লিবিয়ায় কাটানোর পর ঈদুল ফিতরের পর ৪ মে তাদের ‘গেম’ হয়। লিবিয়ার বেনগাজি থেকে কাঠের বোটে রওনা হন তারা। কিন্তু এরপর গতকাল পর্যন্ত ২৩ দিন গেলেও কোনো খোঁজ নেই তাদের। দালালদের পক্ষ থেকে একটি জার্মান জাহাজ সাগরে নষ্ট হওয়া নৌকা থেকে এ ২৬ জনকে উদ্ধার করেছে দাবি করা হলেও তাদের কারও পরিবারের সঙ্গে এ কদিন যোগাযোগ হয়নি। তাদের সন্ধান চেয়ে লিবিয়াপ্রবাসী ও দূতাবাসের কাছে আবেদন করে যাচ্ছে পরিবারগুলো।
জানা যায়, নানান চেষ্টা সত্ত্বেও ইউরোপ যেতে ভূমধ্যসাগরে বাংলাদেশিদের মরণযাত্রা থামছেই না। দিন যাচ্ছে আর স্বপ্নে বিভোর যুবকদের ভিড়ও বাড়ছে লিবিয়ায়। স্থানীয় পুলিশ ও কোস্টগার্ডের অভিযানে লিবিয়ায় প্রায় প্রতিদিনই আটক হচ্ছেন বাংলাদেশিরা। সাগর থেকে উদ্ধারও হচ্ছেন নিয়মিত। খাটতে হচ্ছে জেল। আবার জীবন বাজি রেখে এ পথে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন অনেকে। বেঁচে থাকা অনেককে ফিরতে হচ্ছে নিস্বরিক্ত হয়ে। বৃহস্পতিবার এমন ১৬০ হতভাগ্য ফিরে এসেছেন বাংলাদেশে। এর পরও ইউরোপের হাতছানি থেকে ফেরানো যাচ্ছে না বাংলাদেশিদের।
লিবিয়া ও তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড এবং ইউরোপের উদ্ধার অভিযান চালানো এনজিওগুলোর তথ্যানুসারে বৃহস্পতিবার ভূমধ্যসাগরে একটি কাঠের নৌকা থেকে ১০৯ শরণার্থীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশি ১০৪ জন, আফ্রিকান তিনজন ও মরক্কোর দুজন। ২৩ মে লিবিয়া থেকে ছাড়া এ নৌকার যাত্রীদের উদ্ধার করেছে এস্ট্রাল ও নাদির নামে দুটি জাহাজ।
একই দিন তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে ৭৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন। লিবিয়ার জুয়ারা থেকে শতাধিক যাত্রী নিয়ে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করে তিউনিসিয়া উপকূল স্ফাক্সে যাওয়ার পর নৌকাটি ডুবে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, এখানেও বাংলাদেশি রয়েছেন। ১৪ মে ভূমধ্যসাগর থেকে ৮০ জন শরণার্থীকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়া নৌবাহিনী। লিবিয়া থেকে ছেড়ে যাওয়া কাঠের নৌকাটি থেকে বাংলাদেশি, মরক্কো ও মিসরের শরণার্থীদের উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে তিউনিসিয়া নৌবাহিনী। আন্তর্জাতিক অভিবাসনবিষয়ক সংস্থার (আইওএম) তথ্যানুযায়ী ভূমধ্যসাগরে ২০২১ সালে ডুবে গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন এমন অভিবাসী, শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪০১। মেডিসিন্স সান্স ফ্রন্টায়ার্সের তথ্যমতে, গত সপ্তাহে ৭২ ঘণ্টায় ৪৭০ জনকে ভূমধ্যসাগর থেকে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। গত মাসে একটি অভিযানেই এ সংস্থার প্রতিনিধিরা ৯৬ জনকে মৃত অবস্থায় পেয়েছেন। মাত্র চারজনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। জীবিতরা উদ্ধার হওয়ার আগ পর্যন্ত কমপক্ষে চার দিন সমুদ্রে ভেসে ছিলেন। লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তারা জানান, লিবিয়া ও তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড কাউকে উদ্ধার করলে তাকে ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে রাখা হয়। আবার সম্প্রতি লিবিয়ার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় হয়ে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে কয়েক শ আটক করেছে বলে খবর এসেছে। স্থানীয় প্রক্রিয়ার কারণে তাদের খোঁজ পেতে কয়েকদিন লেগে যায়। পরে পরিচয় নিশ্চিত হলে দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। অনেকে দেশে যেতে চান না। তবে দূতাবাসের প্রচেষ্টার পর লিবিয়ার ডিটেনশন সেন্টারে আটকদের মধ্য থেকে বৃহস্পতিবার ১৬০ বাংলাদেশি নাগরিককে আইওএমের সহায়তায় দেশে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ডিটেনশনে থাকা অবশিষ্টদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশে প্রত্যাবাসনের জন্য দূতাবাসের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।