বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আশার জাল বুনছে পশ্চিমবঙ্গও

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী শনিবার উদ্বোধন করবেন বহুপ্রত্যাশিত পদ্মা সেতু। পরদিন ২৬ জুন গাড়ি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে এ সেতু। অনেকেই বলছেন এ সেতু চালু হয়ে গেলে পদ্মাপারের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির যেমন ইতিবাচক বদল ঘটবে ঠিক সেভাবেই প্রতিবেশী দেশ ভারত বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। পশ্চিমবঙ্গের সাবেক পরিবহনমন্ত্রী ও বিধানসভায় তৃণমূল কংগ্রেস সদস্য মদন মিত্র বলেন, ‘যে কোনো সেতুর উদ্বোধন বা কোনো কারখানার উদ্বোধন- এর অর্থই হলো তার মাধ্যমে মানুষ উপকৃত হয়। আমরা আশা করব যে এ পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যে যাতায়াত করার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে।’ একটি পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেন, ‘শ্যামলী পরিবহনের মতো উন্নতমানের প্রায় সাড়ে এগারো শ বাস বাংলাদেশ জুড়ে যাতায়াত করে। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের সেতু যত তৈরি হবে, সাধারণ মানুষ তত বেশি উপকৃত হবেন।’

কলকাতা প্রেস ক্লাবের সভাপতি স্নেহাশীষ সুর জানান, ‘পদ্মা সেতু কেবল বাংলাদেশের গর্ব নয়, এ সেতু উপমহাদেশের গর্ব। এটি স্থাপত্যের এক অভিনব নিদর্শন। এর দৈর্ঘ্য, ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা, সড়কপথে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা তো আছেই, এ সেতু বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদে তৈরি। ফলে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে আর্থসামাজিক উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে- এটা তার একটা বহিঃপ্রকাশই নয়, তার একটা পরিচায়ক। আর সেটা করে বাংলাদেশ দেখাতে পেরেছে।’

স্নেহাশীষ সুর বলেন, ‘এ সেতুর ফলে পণ্য যাতায়াত, মানুষের যাতায়াত অনেক সুবিধাজনক হবে, অনেক সময় কমে যাবে। কলকাতা-ঢাকার মধ্যেও সড়কপথে সময় অনেক কমে যাবে। এটা দুই পারের মানুষের কাছেই বড় আনন্দের বিষয়। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যেও যাতায়াতের ক্ষেত্রে দূরত্ব অনেক কমে যাবে। এতে ভারতও উপকৃত হবে।’

তিনি বলেন, ‘ভুটান-বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া-নেপাল’ অর্থাৎ বিবিআইএনভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সড়কপথে গাড়ি চলাচল নিয়ে যে চুক্তির কথা হচ্ছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সেতু বাংলাদেশের একটা প্রত্যয়ের নিদর্শন, উন্নয়নের নিরিখের নিদর্শন- যা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মানুষ ও পণ্য চলাচলের উন্নতি হবে তাই নয়, এ উপমহাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন হবে, যোগাযোগ বাড়বে। কারণ যোগাযোগই বর্তমান দুনিয়ার শেষ কথা।’

বিশিষ্ট লেখক এবং কলকাতা বইমেলার আয়োজক সংস্থা ‘কলকাতা বুক সেলার্স অ্যান্ড গিল্ড’-এর সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘ভারতের থেকে যেসব পণ্যবাহী ট্রাক আগরতলা, আসাম বা ত্রিপুরায় যায় এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে... এ সেতু হলে সে সময় অনেক কমে যাবে। ফলে পরিবহনের ক্ষেত্রে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন একটা ডানা যুক্ত হবে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আরও বহুগুণ বাড়বে কারণ ব্যবসায়িক বাণিজ্যিক আদান-প্রদান হবে। যে মুহূর্তে তাড়াতাড়ি পণ্য যাবে বাংলাদেশের প্রচুর রাজস্ব তৈরি হবে।’

তাঁর অভিমত, ‘পদ্মা সেতু গোটা পৃথিবীর বুকে বিস্ময়। বাংলাদেশ এটা তার নিজস্ব প্রযুক্তি, অর্থায়নে তৈরি করেছে। ভারতীয় হয়েও আমরা বাংলাদেশের বাঙালিদের প্রতি গর্বিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমাদের অভিনন্দন। আমরা মনে করি, এ সেতু সমস্ত বাঙালির গর্ব।’ লেখক সুধাংশু শেখর দে বলেন, ‘খুবই আনন্দের বিষয়। শেখ হাসিনা দারুণ একটা কাজ করে দিলেন; এ সেতু হয়ে মানুষ বাংলাদেশ থেকে কম সময়ে আসতে পারবে আমরাও অনেক কম সময়ের মধ্যে অনেক জিনিসপত্র বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসতে পারব, আবার বাংলাদেশেও নিয়ে যেতে পারব। এ সন্তোষ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।’ লোকসংগীতশিল্পী ও বিধানসভায় বিজেপি সদস্য অসীম সরকারের বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রয়েছে; তিনি বলেন, ‘শীতকালে অতিরিক্ত কুয়াশার কারণে আরিচা ঘাটে নদী পারাপার সম্ভব হতো না। সে ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে না।’ পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আশায় বুক বেঁধেছেন কলকাতার নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরাও। সেতু চালু হয়ে গেলে ‘মিনি বাংলাদেশ’ বলে খ্যাত নিউমার্কেটে বাংলাদেশ পর্যটকের ঢল নামবে। খুব কম সময়ে তারা দুই বাংলার মধ্যে যাতায়াত করতে পারবেন। স্বাভাবিকভাবেই কেনাকাটাও বাড়বে, আখেরে লাভ হবে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের।

নিউমার্কেটের নামকরা ‘কটন গ্যালারি’র কর্ণধার কামরুদ্দিন মল্লিক বলেন, ‘এখন ফেরি দিয়ে আসতে হয় বলে দু-তিন ঘণ্টা সময় বেশি লাগছে, যাত্রীদের অনেক হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। পদ্মা সেতু চালু হলে আরও বেশি সংখ্যায় বাংলাদেশ থেকে পর্যটক এপারে আসতে পারবেন। আমরা পদ্মা সেতুর অপেক্ষায় আছি; সেতুটি চালু হলে আমাদের ব্যবসা বৃদ্ধি হবে। তা ছাড়া কলকাতার নিউমার্কেট ব্যবসাটা অনেকটাই বাংলাদেশ পর্যটকদের ওপর নির্ভর করে চলে, সে ক্ষেত্রে স্থানীয় ফুটপাথওয়ালা, রিকশাওয়ালা, বেকারদের কর্মসংস্থান হবে।’

কলকাতার নিউমার্কেট এলাকার বিখ্যাত পোশাক বিপণনী সংস্থা ‘মিলন’-এর কর্ণধার আশিস দত্ত বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে বর্তমান যা খদ্দের বা গ্রাহক আছে তার থেকে সেই গ্রাহকের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা চাই বাংলাদেশি খরিদ্দারের সংখ্যা বাড়ুক। এখন ৭০ ভাগ খরিদ্দার থাকলে, পদ্মা সেতু চালু হলে আগামী দিনে তা ১০০ ভাগে পৌঁছাতে পারে।’

পদ্মা সেতু নিয়ে খুশি বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আসা বিদেশি নাগরিকরাও। অন্যদিকে মারকুইস স্ট্রিট এলাকায় কেনাকাটা করতে আসা মুহাম্মদ রবিন নামে এক বাংলাদেশি পর্যটক জানান, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে আমাদের আরও বেশি আসা হবে, কারণ সে ক্ষেত্রে সড়কপথের দূরত্ব অনেকটা কমে যাবে।’ এ সেতু নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি। ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা রাজু বলেন, ‘জন্মের পর থেকে শুনে আসছি ভারতের কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনেক সহজ হয়েছে। এ দুই দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর, ভালো। তার ওপর পদ্মা সেতু হলে আমরা আরও এক ধাপ এগিয়ে যাব।’

সর্বশেষ খবর