বুধবার, ৬ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

বারবার ডানা ভাঙে বিমানের

হ্যাঙ্গারে পরপর ঘটছে সংঘর্ষ, সংকট কাটছে না, চলছে ২১ উড়োজাহাজে, শিডিউলে ঘটে বিপর্যয়, পাইলট-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানামুখী কর্মসূচিতে মাঝেমধ্যে হয় স্থবির

নিজস্ব প্রতিবেদক

বারবার ডানা ভাঙে বিমানের

সম্প্রতি সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত বিমানের অংশ

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজের মধ্যে প্রায়ই ঘটছে সংঘর্ষ। দফায় দফায় সংঘর্ষে ডানা ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিমান। এ ছাড়া পাইলট, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবি, সিন্ডিকেটের নানামুখী ষড়যন্ত্রে নাজেহাল সংস্থাটি। বিমানের ২১টি উড়োজাহাজের মধ্যে সংঘর্ষ, ওভারপাওয়ারে ইঞ্জিন নষ্ট হওয়া, পাখির আঘাতসহ নানা ঘটনায় প্রতি মাসে অচল থাকছে একাধিক উড়োজাহাজ। দুই উড়োজাহাজের মধ্যে গত রবিবারের সংঘর্ষের ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব মো. মহিদুল ইসলাম। সদস্য হলেন- মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. নজরুল ইসলাম সরকার, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক আবদুল কাদের, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের উপমহাব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রবিবার সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় আসে বিমানের ৭৮৭ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ। যাত্রী নামিয়ে রাত ৯টার দিকে উড়োজাহাজটি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হ্যাঙ্গারে নেওয়া হয়। এ সময় আগে থেকেই হ্যাঙ্গারে একটি ৭৩৭ উড়োজাহাজ ছিল। ৭৮৭ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজটি ভিতরে প্রবেশ করানোর সময় ৭৩৭ উড়োজাহাজের ডানায় আঘাত লাগে। এতে ৭৮৭ উড়োজাহাজের ডান পাশের ডানা ও ৭৩৭ উড়োজাহাজের বাঁ পাশের ডানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এর আগে ১০ এপ্রিল একইভাবে বিমানের দুটি উড়োজাহাজের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। ওই সময় একটি বোয়িং ৭৭৭ ও একটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে ঘটনায় ১১ মে বিমানের    মুখ্য প্রকৌশলীসহ পাঁচজনকে বরখাস্ত করা হয়। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানায় বিমান। ওই ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন বিমানের মুখ্য প্রকৌশলী মোহাম্মদ বদরুল ইসলাম, প্রকৌশলী মো. মাইনুল ইসলাম, সৈয়দ বাহারুল ইসলাম, সেলিম হোসেন খান ও জিএসই অপারেটর মো. হাফিজুর রহমান।

বিমানের প্রকৌশল বিভাগের কর্মীদের অভিযোগ, জনবল সংকট, নিয়মিত কর্মীদের প্রশিক্ষণ না হওয়ায় এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। নিম্নপদের কর্মীদের দোষারোপ করে দায় এড়াচ্ছেন বিমানের প্রকৌশল বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের সাবেক এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিমানে ভয়ংকর ঘটনা ঘটছে। হ্যাঙ্গারে বিমান নেওয়ার সময় তিনজন টোম্যান থাকেন। আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী দুর্ঘটনা এড়াতে উড়োজাহাজের দুই ডানায় দুজন টোম্যান থাকেন, পেছনের অংশে থাকেন একজন। কিন্তু বিমানে এসব কিছুই না মানায় বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। উড়োজাহাজকে সব সময় হ্যাঙ্গারে নিয়ে যাওয়ার দরকারও পড়ে না। বিমানের ব্যবস্থাপনার অদক্ষতার কারণে এবং আগের ঘটনায় দোষীদের শাস্তি না হওয়ায় বারবার একই ঘটনা ঘটছে। তিনি আরও বলেন, ‘ওভারপাওয়ার দিয়ে উড়োজাহাজের ইঞ্জিন পুড়িয়ে ফেলা এর আগেও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে ঘটেছে। লিজে নেওয়া ইজিপ্ট এয়ারের ইঞ্জিন ওভারপাওয়ার দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন পাইলট। এর জন্য বড় অঙ্কের গচ্চা দিতে হয়েছে বিমানকে। কিন্তু পাইলটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবার হয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজে। জবাবদিহিতা না থাকায় একই ঘটনা বারবার ঘটছে।’

গত ৪ এপ্রিল জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেছেন, বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে যাত্রী পরিবহনের জন্য উড়োজাহাজের সংখ্যা ২১। এর ১৮টি নিজস্ব এবং তিনটি লিজ নেওয়া।

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন ক্রয় চুক্তির আওতায় ২০১১-২০২১ সাল পর্যন্ত বিমান বহরের জন্য মোট ১৫টি নতুন উড়োজাহাজ কেনা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১১ থেকে ২০১৯ সময়ে চারটি ৭৭৭-৩০০ ইআর, দুটি ৭৩৭-৮০০, চারটি ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার ও দুটি ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ- এ ১২টি নতুন উড়োজাহাজ সংগ্রহ করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে বহরে থাকা পুরনো উড়োজাহাজ বাতিল করে বহর আধুনিকায়ন করে বাংলাদেশ বিমান এক নতুন যুগে প্রবেশ করে।’ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রুটে পরিচালনার জন্য তিনটি ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ কিনতে বিমান ও কানাডিয়ান কমার্শিয়াল করপোরেশনের (সিসিসি) মধ্যে ২০১৮ সালের ১ আগস্ট জিটুজি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর আওতায় কেনা প্রথম উড়োজাহাজটি ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর, দ্বিতীয়টি ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ও তৃতীয়টি ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিমান বহরে যুক্ত হয়। লিজ ভিত্তিতে পরিচালিত একটি ড্যাশ ৮-৪০০ উড়োজাহাজ ২০২০ সালের জুন ও ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আরও দুটি ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ বিমান বহরে সংযোজন করা হয়।’

ফ্লাইট চলাকালে ওভারপাওয়ার ব্যবহারের কারণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ ‘আকাশতরী’র দুটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিমানের ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ায় গচ্চা গেছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এ ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে- গত ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ ‘আকাশতরী’র বিজি-৬০১ ফ্লাইটের ইঞ্জিনে ওভারপাওয়ার ব্যবহার করেন বৈমানিক। এর ফলে আকাশতরীর দুটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিমানের প্রকৌশল ও ফ্লাইট অপারেশন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মাত্র ১৩ সেকেন্ডের অবহেলায় আকাশতরীর বিজি-৬০১ ফ্লাইটের ?দুটি ইঞ্জিনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্টস জ্বলে যায়। বিমান কর্মকর্তারা বলছেন, উড়োজাহাজটি আকাশে ওঠার পর পাইলট কোনো কারণ ছাড়া পাওয়ার লিভারটিতে ১০০ ভাগের বেশি ইমারজেন্সি পাওয়ার (ওয়াল টু ওয়াল) ব্যবহার করেন। পরবর্তী সময়ে তড়িঘড়ি করে পাওয়ার লিভারটি আবার শতভাগের জায়গায় ডিটেন্টে নিয়ে এলেও দেখা গেছে ১৩ সেকেন্ড ব্যবহৃত হয়েছে।

গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ বিমানের বহরে যুক্ত হয় ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০ মডেলের এ উড়োজাহাজটি। কানাডার ডি হ্যাভিলেন্ড অ্যারোস্পেস থেকে এটি বাংলাদেশে আসে। কানাডা ও বাংলাদেশ সরকারের জিটুজি চুক্তিতে উড়োজাহাজটি কেনা হয়। বিমানটির দাম ছিল ২৫ মিলিয়ন ডলার।

বিমানের দুটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বৈমানিকরা বিমানের মেইনটেন্স লগবুকে তা উল্লেখ না করে তথ্য গোপন করেন। ফলে ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্যটি তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। এর পরও ওই বিমান দিয়ে আটটি ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে। এতে ঝুঁকির মুখে ফেলা হয় ৫ শতাধিক যাত্রীর জীবন। এমনকি বৈমানিকরা এ তথ্য গোপন করলেও বিমানের প্রকৌশল বিভাগ থেকে কোনো ধরনের তদারকি করা হয়নি। পরবর্তীতে উড়োজাহাজ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের একাধিক ইমেলে বিষয়টি নজরে আসে বিমান কর্তৃপক্ষের। এর শাস্তিস্বরূপ শুধু ‘কশন’ নোটিস করা হয়েছে পাইলটদের। প্রায় প্রতি মাসেই বিভিন্ন কারণে একাধিক ফ্লাইট অচল থাকছে। এর সঙ্গে কখনো পাইলটদের কর্মসূচি কিংবা কর্মকর্তাদের কর্মসূচির নানামুখী দাবিতে বিপর্যস্ত হচ্ছে ফ্লাইট পরিচালনা। গন্তব্য বাড়লেও উড়োজাহাজ অচল থাকায় ফ্লাইটের শিডিউল ঠিক রাখতে হিমশিম পরিস্থিতি বিমানের। এর সঙ্গে নানামুখী সিন্ডিকেট সামাল দিতে নাজেহাল অবস্থায় বিমান। সংকটের কারণে চাহিদা থাকলেও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারছে না বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর