সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি আজও অধরা

উবায়দুল্লাহ বাদল

বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি আজও অধরা

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর পেরিয়ে গেছে ৪৭টি বছর। এমনকি মামলার রায়ও ঘোষণা হয়েছে এক যুগ হতে চলল। মামলার ১২ আসামির মধ্যে ছয়জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। একজন পলাতক অবস্থাতেই বিদেশে মারা গেছেন। বাকি পাঁচজন বিদেশে পলাতক থাকলেও আজও এ খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। তাদের দেশে ফেরাতে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি চার খুনির মুক্তিযুদ্ধের খেতাব বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া খুনিদের আত্মীয়ের মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং ছাড়া দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি পলাতক পাঁচ খুনির মধ্যে এ এম রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরী ছাড়া বাকি তিনজন শরিফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন খান ও খন্দকার আবদুর রশিদ কোথায় আছেন, সে বিষয়ে সরকারের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যও নেই। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অবস্থান করা বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীকে দেশে ফেরানো নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তবে দেশগুলোর আন্তরিকতার অভাবে এ দুই খুনিকে দেশে ফেরাতে দেরি হচ্ছে। অন্যদিকে বাকি তিন খুনির বিভিন্ন দেশে অবস্থান পরিবর্তনের তথ্য পাওয়া গেলেও এ মুহূর্তে কোন দেশে আছেন সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বার্তা পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের চেষ্টার কমতি নেই। সমস্যা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত খুনিদের ফেরত দিতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা খুনি রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের পর্যালোচনা করছে দেশটির বিচার বিভাগ। কানাডায় থাকা নূর চৌধুরীকে ফেরানো নিয়েও চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিদেশে পলাতক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফেরত আনা-সংক্রান্ত ‘বিচারার্থে ও দন্ডার্থে বিদেশে অবস্থানরত আসামিদের (বাংলাদেশের নাগরিক) বাংলাদেশে আনয়নের বিষয়ে পর্যালোচনা ও এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নিমিত্তে টাস্কফোর্স’-এর প্রথম বৈঠক ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। টাস্কফোর্সের সভাপতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ছাড়াও এর সদস্য হিসেবে রয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন।

এ ছাড়া অ্যাটর্নি জেনারেলসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশপ্রধান ও গোয়েন্দাপ্রধানরা এ কমিটির সদস্য। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত ছিল পলাতক দন্ডপ্রাপ্ত খুনিদের অবস্থান নিশ্চিত হতে তাদের আত্মীয়স্বজনের মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং অব্যাহত থাকবে। তারা তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন কি না তাও খতিয়ে দেখতে হবে। কানাডায় পলাতক নূর চৌধুরী ও যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রাশেদ চৌধুরীর ফোন নম্বর সংগ্রহ করে ফোন নম্বর ট্র্যাকিং অব্যাহত রাখতে হবে। দ প্রাপ্তদের পাসপোর্ট বাতিল না হলে তা বাতিল এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বিষয়ে খোঁজ পাওয়া মাত্রই রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এরপর টাস্কফোর্সের আরও দুটি বৈঠক হলেও এ বিষয়ে কানো অগ্রগতি নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

 

এদিকে ঘটনার ৪৬ বছর পর গত বছর ৬ জুন বঙ্গবন্ধুর চার খুনির মুক্তিযুদ্ধের খেতাব বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এরা হলেন লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম (বীর উত্তম, গেজেট নম্বর ২৫), লে. কর্নেল এস এইচ এম এইচ এম বি নূর চৌধুরী (বীর বিক্রম, গেজেট নম্বর ৯০), লে. এ এম রাশেদ চৌধুরী (বীরপ্রতীক, গেজেট নম্বর ২৬৭) এবং নায়েক সুবেদার মোসলেম উদ্দিন খান (বীরপ্রতীক, গেজেট নম্বর ৩২৯)।

স্বাধীনতার পরাজিত শত্রু ও তাদের দেশি-বিদেশি দোসরদের ষড়যন্ত্রে ঘাতকের বুলেটে নির্মমভাবে নিহত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এ ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ সময়। ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা এলে প্রথমবারের মতো মামলা দায়ের করা হয়। বিচার প্রক্রিয়া শেষে ২০০৯ সালে বিচারিক আদালত ১৫ জনকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), এ কে বজলুল হুদা এবং এ কে এম মহিউদ্দিনের (আর্টিলারি) মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। পলাতক ছয় খুনির মধ্যে আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০২০ সালের ১১ এপ্রিলে। বঙ্গবন্ধুর বাকি পাঁচ দন্ডিত খুনিকে এখনো দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। খুনিদের ফেরাতে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি চলছে আইনি প্রক্রিয়া। তবু দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না থাকায় খোদ সরকারের মধ্যেই ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মহলের মতে, এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরবচ্ছিন্ন কূটনৈতিক যোগাযোগসহ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে চাপ প্রয়োগ করা দরকার। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দিবসেই শুধু এ প্রসঙ্গ উপস্থাপন করে দায় সারছে।

বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। তাকে ফেরত আনার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে বলেও একাধিকবার গণমাধ্যমে কথা বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর আইনি প্রক্রিয়া চলমান আছে। তাকে ফেরাতে পারব বলে আমাদের বিশ্বাস। যুক্তরাষ্ট্রে তার নাগরিকত্বের বিষয়ে আদালতে একটি শুনানি চলমান রয়েছে। আশা করি তার নাগরিকত্ব বাতিলের রায় আসবে। তখন আমরা আরও একধাপ এগিয়ে যাব। এর আগে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেওয়ার জন্য ২০১৮ সালে দুই বার এবং ২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে একবার চিঠি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া আমি নিজেও যখন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার কারও সঙ্গে কথা বলি, তাদের কাছেও রাশেদ চৌধুরীকে ফেরাতে সহযোগিতা চেয়েছি। তারা শুধু আইনের কথা বলেন।’

খুনি নূর চৌধুরী বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নূরকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেওয়া হয়। এরপর ২০০৯ সালে আবারও ক্ষমতায় এসে নূরকে ফেরত চায় দলটি। এরই মধ্যে কানাডা থেকে বহিষ্কার এড়াতে নূর চৌধুরী সে দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের দফতরে প্রি রিমুভাল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট আবেদন করেন। সেখানে নূর উল্লেখ করেন, কানাডা থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হলে তাকে ফাঁসি দেওয়া হবে। এ ধরনের আবেদন সাধারণত এক বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করা হয়ে থাকে। কিন্তু নূর চৌধুরীর ক্ষেত্রে কানাডার অ্যাটর্নি জেনারেল ১০ বছরেও তা নিষ্পত্তি করেননি। বাংলাদেশ ২০১৮ সালের জুলাইয়ে কানাডার ফেডারেল কোর্টে একটি মামলা দায়ের করে, যাতে কানাডা নূর চৌধুরীর স্ট্যাটাস আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে। পরের বছর ১৭ সেপ্টেম্বর আদালত বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিলেও কানাডা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এ ছাড়া তিন খুনির মধ্যে মোসলেম উদ্দিন খান ইউরোপের কোনো একটি দেশে পালিয়ে আছেন বলে ধারণা করা হয়। করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর জুনে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারে বঙ্গবন্ধুর এ খুনি ভারতে আটক হওয়ার খবর ছাপে। কিন্তু বিষয়টি পরে নিশ্চিত হতে পারেনি বাংলাদেশ। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি শরীফুল হক ডালিম পাকিস্তান, লিবিয়া বা স্পেনে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর খন্দকার আবদুর রশিদ পাকিস্তান বা আফ্রিকার কোনো একটি দেশে পালিয়ে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের বিষয়ে সুর্নিদিষ্ট কোনো তথ্য নেই বাংলাদেশের কাছে।

সর্বশেষ খবর