বুধবার, ৩১ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা
মায়ের ডাকের মানববন্ধনে আকুতি

স্বজনদের ফিরিয়ে দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বজনদের ফিরিয়ে দিন

রাজধানীতে গতকাল মানববন্ধনে অংশ নেন নিখোঁজদের স্বজনরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

গুম হওয়া স্বজনদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে ‘মায়ের ডাক’ নামের সংগঠনের ব্যানারে রাজধানীর শাহবাগে গতকাল মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। গুম হওয়া মানুষের ১০০টি পরিবারের সদস্যরা সেখানে অংশ নিয়েছেন। তারা তাদের পরিবারের নিখোঁজ তথা গুম হওয়া স্বজনদের ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আকুল আকুতি জানিয়েছেন সরকারের প্রতি। ‘বিশ্ব গুম প্রতিরোধ দিবস’ উপলক্ষে জাতীয় জাদুঘরের সামনে গতকাল অনুষ্ঠিত এ কর্মসূচিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সংহতি প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্বজনদের দাবি, অবিলম্বে যেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য তাবিথ আউয়াল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মাহবুব হোসেনসহ গুম হওয়া পরিবারের স্বজনরা এতে বক্তব্য রাখেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য চৌধুরী আলমের ছোট ভাই খুরশীদ আলমও মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন।

মানববন্ধনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ১১ বছরের শিশু আদিবা ইসলাম বলে, ‘বাবাকে ছাড়া আমার ভালো লাগে না। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি বাবার সঙ্গে স্কুলে যেতে চাই। বাবাকে ছাড়া আমার একটুও ভালো লাগে না।’ বাবার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে শিশুটি। আদিবা ইসলামের বাবার নাম পারভেজ হোসেন। তিনি বংশাল থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আদিবা ইসলামের মায়ের দাবি, তার স্বামীকে ২০১৩ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে একদল লোক তুলে নিয়ে যায়। তিনি আর ফেরেননি। ১০ বছরের শিশু সাদিকা সরকার সাফার মায়ের দাবি, ২০১৩ সালে তার স্বামী মো. সোহেলকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে যাওয়ার পর এখনো তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। মো. সোহেল বংশাল থানা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ছিলেন। কিশোরী তামান্না ইসলাম বলেন, ‘আমার বাবা ইসমাইল হোসেন বাতেন ২০১৯ সালে র‌্যাবের হাতে আটক হন। স-মিল থেকে বাসায় আসার পথে বাবাকে গুম করা হয়। সেদিনই আমরা জিডি করেছিলাম। কিন্তু পুলিশ র‌্যাবের বিরুদ্ধে জিডি নেয়নি। তবে র‌্যাবের নাম বাদ দিয়ে ওরা সাধারণ ডায়েরি করেছে।’ তামান্না বলেন, ‘এরপর র‌্যাব হেডকোয়ার্টার্স, পুলিশ, ডিবি, ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয় এবং মানবাধিকার কমিশন- এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে আমরা যাইনি। কিন্তু আজ পর্যন্ত বাবার কোনো সন্ধান পাইনি। দিনের পর দিন আমি আমার বাবার ছবি হাতে দাঁড়িয়ে থেকেছি।’ বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য চৌধুরী আলমের ছোট ভাই খুরশীদ আলম বলেন, ‘২০১০ সালের ২৫ জুন ইন্দিরা রোড থেকে আমার বড় ভাইকে সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই থেকে তার খোঁজ নেই। সরকারকে বলছি, আপনি যদি আমার ভাইকে মেরে ফেলেন, তাহলে একমুষ্টি মাটি দেওয়ার জন্য লাশটা ফেরত দিন। আর বিচার চাইব না। আর কোনো দাবিও নেই। শুধু ভাইয়ের লাশটা চাই।’ নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আয়নাঘর’ চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু সরকার এ নিয়ে মিথ্যাচার করছে। এ সরকার একটি ডাকাত সরকার। বাবাহারা, মাহারা এই শিশুদের, স্বামীহারা মায়েদের এই হৃদয়বিদারক কান্না তাদের কানে পৌঁছায় না। গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এই সরকারের কাছে আপনারা দয়া-দাক্ষিণ্য, ভালোবাসা পাবেন না। যারা জাতিসংঘের কাছেও মিথ্যাচার করে, তাদের কাছে বিচার পাওয়া সম্ভব নয়। তাই শপথ নিন, যত আয়নাঘর আছে, আমরা সবাই মিলে ভেঙে ফেলব।’

তিনি বলেন, ‘দেশে একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন। তার মতো ফালতু কথা বলায় বিখ্যাত লোক সম্ভবত আর পৃথিবীতে নেই। তিনি বললেন, সুইডেনের কোম্পানি আয়নাঘর বিষয়ে মিথ্যা কথা বলেছে। কিন্তু অনেক সংবাদমাধ্যম স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সেই জায়গা পর্যন্ত চিহ্নিত করে দিয়েছে। সরকারের যদি এতই বাড়াবাড়ি করার ইচ্ছে থাকে, তাহলে আমাদের সেখানে যেতে দিক। আমাদের যেতে দিতে সাহস না হলে নিরপেক্ষ কাউকে যেতে দিক। তাও না পারলে জাতিসংঘকে যেতে দিক।’ নুরুল হক নূর বলেন, ‘রাষ্ট্রের চরিত্র না বদলালে আমরা গুম হওয়া মানুষদের আদৌ পাব কি না জানা নেই। আমরা যারা গুম-খুনের বিরুদ্ধে কথা বলছি, তারা কতক্ষণ রাস্তায় মুক্ত থাকতে পারব, সেটিও জানি না। কারণ গুমের প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত। আয়নাঘরের যে সন্ধান মিলেছে, আমার ধারণা গুম হওয়া ব্যক্তিরা সেখানেই আটকে আছেন। আওয়ামী লীগের ক্যাসেট মন্ত্রীরা সেই আয়নাঘর নিয়ে কেন কথা বলছেন না! আওয়ামী লীগ সরকার সেটি ভেঙে দিক। অন্যথায় আমরা আয়নাঘর ঘেরাও করব। এতে যদি আমাদের দিকে কামানও তাক করা হয়, পিছপা হব না।’ অধ্যাপক ড. মো. মাহবুব হোসেন বলেন, এই গুমের সঙ্গে সরকার জড়িত। তাই তাদের কাছে বিচার চেয়ে লাভ নেই। বিএনপি নেতা তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘আমাদের একটাই প্রশ্ন, আমাদের পরিবারের সদস্যরা কোথায় আছেন? এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই বর্তমান সরকারকে দিতে হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে বারবার গুম-খুনের সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করা হচ্ছে। তদন্ত সাপেক্ষে যেটা সত্য সেটা আমরা সবাই মেনে নেব। কিন্তু যখন বারবার অস্বীকার করা হচ্ছে, তখন বোঝা যায়, সব গুম-খুনের সঙ্গে সরকার জড়িত। সেই দিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা ন্যায়বিচার পাব।’

মানববন্ধনে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা গুমের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চান- যেখানে গুমের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য থাকবে। তাদের কোথায় নেওয়া হয়েছে, কে নিয়ে গেছে এবং বর্তমানে তারা কী অবস্থায় আছেন, সেটি তারা জানতে চান। এ ব্যাপারে সরকারের কাছে সুস্পষ্ট বক্তব্য দাবি করেন তারা।

 

 

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর