শনিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ভয়ংকর ফাঁদে পা দিচ্ছে যুবকরা

বেপরোয়া মানব পাচারকারী চক্র । অবৈধ টাকায় দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড়

সাখাওয়াত কাওসার

ভয়ংকর ফাঁদে পা দিচ্ছে যুবকরা

পাচারের টাকায় নির্মিত বিলাসবহুল বাড়ি

ইউরোপের স্বপ্ন দেখিয়ে বেপরোয়া মানব পাচারকারীরা। এ চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন যুবকরা। অনেকে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করলেও মানব পাচারকারীদের পরামর্শে তারা দেশে ফিরছেন। পরবর্তীতে তাদের লিবিয়াসহ বিভিন্ন ট্রানজিট দেশে আটকে রেখে করা হচ্ছে নির্যাতন। স্বপ্নচারী যুবকদের আহাজারি এবং নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থ। এরই মধ্যে অনেককে বাড়ি ফিরতে হয়েছে লাশ হয়ে। অন্যদিকে মানব পাচারের টাকায় দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছে দুর্বৃত্তরা। পাচারকে বৈধতা দিতে মানব পাচারকারীরা আদায় করে নিচ্ছে রিক্রুটিং লাইসেন্সও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লিবিয়ার ত্রিপোলিতে অবস্থান করে মানব পাচার নিয়ন্ত্রণ করছেন কুমিল্লার শরীফ। লিবিয়ায় শরীফ ‘মাফিয়া শরীফ’ নামেই পরিচিত। সাত বছর ধরে লিবিয়ায় মানব পাচারের গডফাদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি। মাদারীপুরের বাসিন্দা দ্বিতীয় স্ত্রী সুমনা আক্তার সুমীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছেন বাংলাদেশি নেটওয়ার্ক। সুমীকে সার্বিক সহায়তা করছেন ফরিদপুরের আক্তারুজ্জামান মোল্লা। এই আক্তারুজ্জামানের মাধ্যমেই মাফিয়া শরীফ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে গত ২৭ সেপ্টেম্বর বাগিয়ে নিয়েছেন মেসার্স আরাফ ম্যানপাওয়ার লমিটেড নামের একটি রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স। দুবাই, মিসর, বেনগাজীতে রয়েছে তার নিজস্ব এজেন্ট। এর মধ্যে দুবাইতে কাজী সাহেব, বেনগাজীতে আবদুুল্লাহ, কুদ্দুস অন্যতম। বাংলাদেশের মাদারীপুর, সিলেট, মুন্সীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে ২০-এর অধিক এজেন্ট। জানা গেছে, দুই মাস আগে রাজধানীর দনিয়ায় ৭০ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন শরীফের দ্বিতীয় স্ত্রী সুমী। রাজধানীর দক্ষিণ দনিয়ার ৩ নম্বর সড়কের এস নাহার গার্ডেনের পঞ্চমতলায় ১৫০০ বর্গফুটের এই ফ্ল্যাট। এর বাইরেও রাজধানীর শ্যামপুরে রয়েছে আরও দুটি ফ্ল্যাট। পার্শ্ববর্তী টঙ্গীতে রয়েছে একটি দোতলা বাড়ি। গত ১০ অক্টোবর ৩৫ লাখ টাকা দিয়ে সুমনা সুমী তার মা মরিয়ম বেগমের নামে কিনেছেন টয়োটা ‘রেইজ’ ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল জিপ। অনুসন্ধান বলছে, ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার আরব আলী নামের একজনের সঙ্গে প্রথম বিয়ে হয় সুমীর। তবে মানব পাচারের কাজে সম্পৃক্ত হয়েই পরিচয় হয় লিবিয়ার ত্রিপোলি থানায় কুমিল্লার শরীফের সঙ্গে। শরীফ লিবিয়ায় মাফিয়া শরীফ নামে পরিচিত। কিছুদিনের মধ্যেই শরীফ এবং সুমী প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যান। এক পর্যায়ে তিন বছর আগে আরব আলীকে তালাক দিয়ে সুমী বিয়ে করেন লিবিয়ায় অবস্থানরত মাফিয়া শরীফকে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের হিউম্যান ট্রাফিকিং বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার তৌহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত ৩০ অক্টোবর মাদারীপুরের আলীম হোসেন মিলনের মা মনি আক্তারের দায়ের করা অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে আমরা শরীফের বিষয়টি অবগত হই। সে লিবিয়ায় শীর্ষ মানব পাচারকারী। দুবাই, বেনগাজীতে রয়েছে তার নিজস্ব আস্তানা। এরই মধ্যে শরীফের দেশীয় এজেন্ট আলমগীর খানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, শত শত বাংলাদেশি তরুণকে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে মানব পাচারকারী চক্রগুলোর ডেরায় আটকে রাখা হয়েছে। মুক্তিপণের টাকা পেলে ভূমধ্যসাগরে ছোট ছোট নৌকায় করে তাদের ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। স্বজনরা টাকা না দিলেই ওই তরুণদের ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। নির্যাতনে কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন। আবার অন্য বন্দিদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিতে পৈশাচিক কায়দায় মেরেও ফেলা হয়। গত ২০২০ সালে লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যার ঘটনা বিশ্বব্যাপী আলোচিত ছিল। বাংলাদেশি শতাধিক মানব পাচারকারী চক্র লিবিয়ায় বসে মানব পাচারের এমন ভয়ানক ব্যবসা করছে। বিপুল অর্থে তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে লিবিয়ার কিছু প্রভাবশালী ও সন্ত্রাসী নাগরিক। একটি ঘটনা : মাদারীপুরের তরুণ আলিম হোসেন মিলন। বাবা মারা যাওয়ায় মা আর ছোট দুই ভাইয়ের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সংসারে আরও একটু স্বাচ্ছন্দ্য আনতে ইতালি যেতে ঋণ আর জমি বিক্রি করে স্থানীয় আলমগীর খান ও কুদ্দুস মোল্যার হাতে সাড়ে ৯ লাখ টাকা তুলে দেন। গত ২৮ মার্চ স্বপ্নের ইউরোপের যাওয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন। পাঁচ দিন পর তার মা মনি আক্তারের ফোনে আসা কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে সন্তানের গগণবিদারী আর্তনাদ। ছেলেকে মুক্ত করতে আলমগীর খানকে আরও ৬ লাখ টাকা দিতে বলা হয়। কিছুদিন পর আবারও ফোন করা হয় মনি আক্তারকে। তবে সন্তানের কষ্ট একটু লাঘব হবে- এমন আশায় ঋণ আর জমি বিক্রি করে ৬ লাখ টাকা দিলেও তার মুক্তি মেলেনি। মিলনের মতো আরও অন্তত ২০০ স্বপ্নচারী যুবক এই চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন লিবিয়ায়। তাদের আর্তনাদকে পুঁজি করে পাচারকারীরা হাতিয়ে নিচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। অভিযোগকারী মনি বেগম জানিয়েছেন, লিবিয়াতে মানব পাচারকারী কুদ্দুস, আবদুল্লাহ ও শরীফসহ তাদের সহযোগীরা বন্দি করে রেখেছে। তার সঙ্গে বন্দি আছে রাসেল, ওমর ফারুক, পারভেজ মিয়া, সাইম মিয়া, ইয়াদ হাওলাদার, আবির পাল, আল আমিন বয়রা, নয়ন বাড়ৈ, উজ্জ্বল মাতুব্বর ও আশিক মাতুব্বর। তারা লিবিয়ার গেম ঘরে আটকে রেখে প্রতিনিয়ত নির্যাতন করছে। সিটিটিসি সূত্র বলছে, ২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে লিবিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো বন্ধ। তবু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার প্রলোভনে দালালের খপ্পরে পড়ে দেশ ছাড়ছেন তরুণ-যুবকরা। তারা রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন দুবাই কিংবা মিসরের বৈধ ট্যুরিস্ট ভিসা। তারপর লিবিয়া যান। টাকা বেশি দিলে দুবাই থেকে চার্টার্ড প্লেনে করে লিবিয়ার বেনগাজীতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সেখান থেকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় ত্রিপোলি। লিবিয়ায় ত্রিপোলির দুর্গম এলাকায় পাচারকারীদের আস্তানা রয়েছে। ইউরোপে নেওয়ার জন্য তরুণ-যুবকদের সেই আস্তানায় নিয়ে রাখা হয়। মাফিয়া শরীফের বিষয়ে এরই মধ্যে তারা তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর