কাকডাকা ভোর। চারদিকে তখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার। শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে হাজির কুয়াশারা অন্ধকার আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। মনপুরা উপজেলার হাজীরহাট লঞ্চঘাটে নেমে মনে হচ্ছিল এ কোথায় এলাম? আশপাশে দু-একটি ছাপরা দোকান ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।
বিশাল জলরাশি পেরিয়ে তীরের দেখা পেয়েছি আমরা। আগের দিন বিকেলে লঞ্চে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। রাত পেরিয়ে ভোর হলো। দীর্ঘ সময় পর ভোলার বিচ্ছিন্ন উপজেলা মনপুরায় পৌঁছলাম।
উদ্দেশ্য আমাদের মহৎ। এখানকার নারীদের জীবনমান উন্নয়নে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো, অর্থনৈকিতভাবে স্বাবলম্বী করতে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে সেলাই মেশিন বিতরণ করা। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে সব সময়ই পাশে দাঁড়ায় দেশের শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপ। সেই ধারাবাহিকতায় দ্বীপজেলা ভোলার বিচ্ছিন্ন উপজেলা মনপুরা ও চরফ্যাশনের ৩০ জন অসচ্ছল নারীকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ এবং সেলাই মেশিন দিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ।
দেশসেরা সামাজিক সংগঠন বসুন্ধরা শুভসংঘের তত্ত্বাবধানে এই প্রশিক্ষণ ও সেলাই মেশিন প্রদান করা হয়। বসুন্ধরা শুভসংঘের প্রতিষ্ঠাতা খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের নির্দেশে বসুন্ধরা শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামানের নেতৃত্বে ঢাকা থেকে একটি টিম মনপুরায় এসে দরিদ্র পরিবারের এই নারীদের হাতে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে সেলাই মেশিন তুলে দেয়।
গত ১৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার মনপুরা আইডিয়াল একাডেমি মিলনায়তনে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের হাতে বিনামূল্যে বসুন্ধরা গ্রুপের উপহার হিসেবে সেলাই মেশিন তুলে দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মনপুরা উপজেলা শাখার সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল খালেক সেলিম মোল্লা, উপজেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি জোবায়ের হাসান রাজীব চৌধুরী, মনপুরা উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক মো. শামসুদ্দিন মোল্লা, বসুন্ধরা ফাউন্ডেশনের সিনিয়র অফিসার মো. মামুন, বসুন্ধরা শুভসংঘ মনপুরা উপজেলা শাখার উপদেষ্টা মো. মোজাম্মেল হক রাজু, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মনপুরা উপজেলা শাখার প্রধান সমন্বয়কারী মো. নুরনবী, উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো. সোহেল তাজ প্রমুখ। বসুন্ধরার দেওয়া সেলাই মেশিন পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মনপুরা উপজেলার নারীরা।
সেলাই মেশিন পেয়ে উপজেলার মনোয়ারা বেগম মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া বলে, ‘বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতি অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা। পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে পড়াশোনার খরচ চালানো খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছিল। বসুন্ধরা শুভসংঘের মাধ্যমে বিনামূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ শেষে আজ সেলাই মেশিন পেয়েছি। এখন আর চিন্তা নেই। এই মেশিনে আয় করে আমি পড়তে পারব। পড়াশোনার পাশাপাশি আমাকে উপার্জনের পথ দেখাবে বসুন্ধরা গ্রুপের দেওয়া এই সেলাই মেশিন।’ উপজেলার রামনেওয়াজ এলাকার রিনা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী মাছ ধরেন। তাঁর অল্প উপার্জনে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে কষ্ট হয়। বসুন্ধরা গ্রুপ থেকে আমি ট্রেনিং ও সেলাই মেশিন পেয়েছি। এখন আমিও কিছু উপার্জন করে স্বামীর পাশাপাশি পরিবারের হাল ধরতে পারব। ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ জোগাতে পারব। আমাদের মতো দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতি অনেক দোয়া। আল্লায় তাদের ভালো করবে।’
মনপুরা উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল খালেক সেলিম মোল্লা বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বিশাল হৃদয়ের মানুষ। তাঁর নির্দেশে বসুন্ধরা শুভসংঘ দেশের বিভিন্ন স্থানে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কাজ করছে। এই উদ্যোগগুলো খুবই প্রশংসনীয় এবং অনুকরণীয়। আজ যেসব নারী সেলাই মেশিন পেয়েছেন, তাঁরা এটি ব্যবহার করে অবশ্যই স্বাবলম্বী হবেন। এমন সুন্দর উদ্যোগ নেওয়ায় বসুন্ধরা শুভসংঘ ও বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানকে আমি আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই।’
উপজেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি জোবায়ের হাসান রাজীব চৌধুরী বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপের দেওয়া এই সেলাই মেশিনের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এটি সত্যি বিরল উদ্যোগ। এভাবে কেউ সাধারণত প্রশিক্ষণ দিয়ে সেলাই মেশিন দেয় না। দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে তাদের উপার্জনের পথ দেখিয়ে দিয়ে ইতিহাস তৈরি করছে বসুন্ধরা গ্রুপ ও বসুন্ধরা শুভসংঘ।’ বসুন্ধরা শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামান বলেন, ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ শুরু থেকেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে। বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ ও সেলাই মেশিন বিতরণ বসুন্ধরা শুভসংঘের একটি বড় কার্যক্রম। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান স্যারের নির্দেশনা ছিল প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র নারীদের টেকসই উন্নয়নের জন্য কিছু কাজ করা। কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন স্যারের নেতৃত্বে ও পরামর্শে সারা দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামীণ অসচ্ছল নারীদের স্বাবলম্বী করতে কাজ করছি। সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের দক্ষ করে বসুন্ধরা গ্রুপের উপহার হিসেবে প্রত্যেককে সেলাই মেশিন তুলে দিই আমরা। গত তিন বছরে তিন হাজারের বেশি নারীকে স্বাবলম্বী করতে সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছে। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন। নিজেদের সংসার চালাচ্ছেন, সংসারে সহায়তার পাশাপাশি সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগাচ্ছেন। আমরা মনে করি, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান স্যারের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। দরিদ্র নারীরা নিজেদের সচ্ছল করতে পারছেন।’ বসুন্ধরা শুভসংঘ মনপুরা উপজেলা শাখার সভাপতি ফজলে রাব্বি রিমনের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান সোয়েবের পরিচালনায় ও সাংগঠনিক সম্পাদক তামজিদ আহমেদ সামির সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বসুন্ধরা শুভসংঘ মনপুরা উপজেলা শাখার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া ১৪ নভেম্বর শুক্রবার সকালে উপজেলা অফিসার্স ক্লাবে ১৫ জন অসচ্ছল নারীর মাঝে এই সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়। এম আমির হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হুদা, পৌর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক খায়রুল ইসলাম সোহেল মিয়া, সাবেক কাউন্সিলর জাহিদুল ইসলাম রাসেল, চরফ্যাশন মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মহিউদ্দিন বাচ্চু, চরফ্যাশন প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামাল গোলদার, বসুন্ধরা শুভসংঘ ভোলা জেলা শাখার সভাপতি মো. শাফায়াত হোসেন প্রমুখ। বসুন্ধরা গ্রুপের এমন মহতী উদ্যোগের প্রশংসা করে অতিথিরা বলেন, বসুন্ধরা শুভসংঘের স্থানীয় শাখার মাধ্যমে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় মানুষকে স্বাবলম্বী করতে কাজ করে যাচ্ছে দেশের বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপ। রমজানে ইফতারি, মাদক নির্মূলে স্কুল-কলেজে সভা-সেমিনার, দুস্থ ও প্রতিবন্ধীদের কলেজে ভর্তি হতে নগদ অর্থ প্রদান, অসচ্ছল নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে সেলাই মেশিন দেওয়া বিশাল বড় মনের পরিচয়। সব ভালো কাজের উদাহরণ বসুন্ধরা শুভসংঘ। প্রশিক্ষণার্থী নাহিদা বলেন, ‘বসুন্ধরা আমাদের সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে মেশিন দিয়েছে। সচ্ছলতায় ফিরবে আমাদের জীবন। বসুন্ধরা গ্রুপকে অনেক ধন্যবাদ ও প্রাণ ভরে দোয়া করছি।’ শারমিন বেগম বলেন, ‘এখন থেকে আমি সেলাই মেশিন দিয়ে ইনকাম করে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো থাকব। বসুন্ধরা শুভসংঘকে ধন্যবাদ জানাই।’

চরফ্যাশনে দরিদ্র পরিবারের নারীদের হাতে সেলাই মেশিন তুলে দিয়েছে বসুন্ধরা শুভসংঘ।