মঙ্গলবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সংকট মোকাবিলায় ছয় নির্দেশনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনা-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ কয়েকটি কারণে ২০২৩ সাল সংকটের বছর হতে পারে। সংকট মোকাবিলায় খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানো ও আমদানিতে উৎসে কর ছাড় দেওয়াসহ ছয়টি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর ২০২১-২২ অর্থবছরের কার্যাবলি সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় এসব বিষয়ে আলোচনা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে আগামী বছর সংকটের বছর হওয়ার আশঙ্কার কথা জানান তিনি। বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর ২০২১-২২ অর্থবছরের কার্যাবলি সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয় জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বৈশ্বিক যে অবস্থাটা আসছে তাতে আমাদের সংকট দেখা যাচ্ছে। আমাদের কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ্বের অর্থনৈতিক এনালাইসিস বলছে, তিনটি কারণে ২০২৩ খুবই একটা সংকটের বছর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফেডারেল রিজার্ভ যেহেতু রেট অব ইন্টারেস্ট বৃদ্ধি করেছে, এটা একটা। দ্বিতীয়ত- কভিডের রিকভারি হওয়ার আগেই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় যে উন্নতি হচ্ছিল সেটা আবার নেগেটিভের দিকে চলে যাচ্ছে। তিন নম্বর- তারা বলছে, চীন উল্লেখযোগ্য হারে উৎপাদন কম করছে। যেটা বিশ্ববাজারকে প্রভাবিত করছে। এ তিনটি কারণে ২০২৩ একটি সংকটের বছর হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সবাইকে একটু এ অনুযায়ী প্রস্তুত থাকতে হবে।

আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রিসভা ও প্রধানমন্ত্রী যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, প্রথম হলো- সর্বাবস্থায় আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। যে যতই খাদ্য আমদানির কথা বলি এ ক্রাইসিসটা থাকবেই। যদিও রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার যেহেতু সংকট হচ্ছে, ফেডারেল রিজার্ভের হার বেড়ে যাওয়ার ফলে যেসব দেশ ঋণ নিয়ে কাজ করে বা যাদের আমদানি বেশি, তাদের দুই দিক থেকেই অসুবিধা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি হলো যখন টাকা দেওয়া হচ্ছে, তখন বেশি দিতে হচ্ছে, আবার যখন নেওয়া হচ্ছে, তখন কম পাওয়া যাচ্ছে। এ জন্য সবাইকে খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে এবং এর সম্ভাবনাও আছে। দ্বিতীয়ত- বিদেশে যেন অদক্ষ শ্রমিক না পাঠিয়ে দক্ষ শ্রমিক পাঠানো হয়। তাতে উচ্চ বেতনে কাজ করা সম্ভব হবে। সংশ্লিষ্ট দেশের চাহিদা অনুসরণ করে যেন এই সুযোগ বাড়ানো হয়। আর দক্ষতার সনদের ক্ষেত্রে যেন যথাযথ প্রতিষ্ঠানের সনদ দেওয়া হয়। তৃতীয়ত- প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) বাড়ানোর জন্য কিছু কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি পরিপত্র দিয়েছে বা না দিলে দেবে যে এখন আর রেমিট্যান্স পাঠাতে আলাদা ফি দিতে হবে না। যে ব্যাংকে পাঠাবে, সেই ব্যাংকই বিষয়টি দেখবে। আরও কিছু ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, চতুর্থত- বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ জন্য বিনিয়োগের যেসব শর্ত আছে, সেগুলোকে আরেকটু নমনীয় করা যায় কি না, সেটি দেখতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষেই (বিডা) কয়েকটি শাখা থাকবে। যেমন লাইসেন্সের জন্য যেন পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনে যেতে না হয়। এ ছাড়া খাদ্য মজুদের বিষয়টি সব সময় ভালো অবস্থায় রাখার বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিসভা। বর্তমানে খাদ্যের মজুদ পরিস্থিতি খুবই ভালো অবস্থায় আছে। বেসরকারি খাতকে প্রায় ১৫ লাখ টন খাদ্য আমদানি করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে উৎসে কর জাতীয় কিছু করের বিষয়ে নমনীয় হওয়ার বিষয়েও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এনবিআর আলাপ-আলোচনা করে অবিলম্বে যেন সন্তোষজনক বিধান চালু করে।

হজযাত্রীদের ইমিগ্রেশন চুক্তি : শতভাগ হজযাত্রীর ইমিগ্রেশন বাংলাদেশের বিমানবন্দরে করতে সৌদি আরবের সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তির খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। একই সঙ্গে সৌদি আরবের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তির খসড়াও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, গত বছর হজযাত্রীদের ইমিগ্রেশনটা এখানে হয়েছে। এবার চুক্তি হয়েছে এখন থেকে আমাদের হজযাত্রীদের ইমিগ্রেশন ঢাকাই হবে।  সৌদির সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, এটার প্রধান বিষয় হলো সন্ত্রাসবাদ, মানব পাচার ও অর্থ পাচার রোধ করা। মাদকদ্রব্য ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধ করা, সৌদি আরবে দক্ষ জনবল পাঠানো ও ভিসা সহজ করা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এ চারটি বিষয়ে সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী এসেছেন। তার সঙ্গে জননিরাপত্তা বিভাগের এ চুক্তি হয়েছে। এখন সে বিষয়ে মন্ত্রিসভা সম্মত হয়েছে। এ বিষয়ে ফাইন্যান্সিয়াল কিছু বিষয় আছে। সেসব বিষয়ে উনারা ফাইন্যান্স থেকে একটা পর্যবেক্ষণ নেবেন।

চিড়িয়াখানা ব্যবস্থাপনায় হচ্ছে আইন : চিড়িয়াখানা সুন্দর ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য ‘চিড়িয়াখানা আইন-২০২২’ এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ বিষয়ে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, চিড়িয়াখানাকে সহজভাবে পরিচালনার জন্য, সুন্দর ও মানুষের উপভোগ্য করার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ আইনটি নিয়ে এসেছে। আইনে বন্যপ্রাণী সংগ্রহের ক্ষেত্রে ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন বা এর অধীনে প্রণীত বিধিমালা পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়, সেই বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আইনটিতে চিড়িয়াখানায় সংগৃহীত প্রাণীর প্রকৃতি ও চাহিদা অনুযায়ী খাঁচা, আবাসন, প্রদর্শন ও তথ্য সংগ্রহ, এ ব্যবস্থাগুলো আরও কার্যকরভাবে করতে হবে বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোনো প্রাণীর অবস্থা যদি এমনই হয় যে, তাকে বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে না বা বেঁচে থাকাটা তার জন্য বেশি কষ্টকর হচ্ছে, সেক্ষেত্রে কারিগরি মতামত নিয়ে কীভাবে ব্যথাহীন মৃত্যুর ব্যবস্থা করা যায়, সেগুলোর বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে। দর্শনার্থীরা যেন উপযুক্ত ফি দিয়ে সুবিধাজনকভাবে দেখতে পারে, সেটা ব্যবস্থা করার জন্য খসড়া আইনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড আইন : গতকালের মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘বাংলাদেশ ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড আইন-২০২২’ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, গরু ও ছাগলের দুধ ব্যবস্থাপনার জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ আইনটি নিয়ে এসেছে। মিল্ক ভিটা রয়েছে সেটা পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এই আইনের অধীনে একটি বোর্ড থাকবে। বোর্ডে চেয়ারম্যান ও তার সঙ্গে সদস্যরা থাকবেন।

উনারা দুগ্ধজাত খাবারের মান ও গুণাগুণের বিষয়টি নিশ্চিত করবে। বিএসটিআই বিভিন্ন পণ্যের মানের বিষয়টি নিশ্চিত করে। কিন্তু দুগ্ধজাত খাবারের মানের বিষয়টি নিশ্চিত করবে এ প্রতিষ্ঠান (ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড)। এটা বিএসটিআইর অধীনে যাবে না। এটা (আইন) কার্যকর করা হলে খামার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, নিরাপদ খাদ্য হিসেবে সরবরাহ নিশ্চিত করারও সুযোগ থাকবে।

জমি খাস হওয়ার তথ্য গুজব : ব্যক্তিগত জমি চাষ না করলে তা খাস হয়ে যাওয়ার প্রচারণাকে ‘গুজব’ বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। মন্ত্রিসভার ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। সম্প্রতি বেশ কিছু জায়গায় একটা বড় গুজব চলছে যে, যেসব জমিতে চাষ করা হবে না সেগুলো খাস হয়ে যাবে। গত দু-তিন দিন আগে রংপুর থেকে ঘুরে এসেছি। আমরা ক্লিয়ার ইন্সট্রাকশন দিয়ে দিয়েছি, কারও জমি চাষ করল না আর আমি খাস করব, এ রকম কোনো পদ্ধতি নেই। খাস করার একটা আলাদা পদ্ধতি রয়েছে। সেটা অনেক দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া। কোনো জমি খাস করার দরকার হলে তাকে (জমির মালিককে) নোটিস দিতে হবে, তার কাছে শুনতে হবে। জমিতে চাষ না করলেই সেটা খাস করে ফেলা হবে, এমন কোনো প্রভিশন নেই। এটা একটা ‘গুজব’, যা চারদিকে ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

এ ছাড়া বৈঠকে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়াতে ‘অ্যাগ্রিমেন্ট অন কো-অপারেশন অ্যান্ড মিউচুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্স ইন কাস্টমস ম্যাটারস’ এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

সর্বশেষ খবর