সোমবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

মেসির আর্জেন্টিনা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন

মেসির আর্জেন্টিনা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন

চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। চ্যাম্পিয়ন লিওনেল মেসি। কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে (৪-২) তিন যুগ পর বিশ্বকাপ জয় করল আর্জেন্টিনা। শাপমোচন করলেন লিওনেল মেসি। আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ শিরোপা উপহার দিয়ে ইতিহাসের সেরা ফুটবল কিংবদন্তিতে পরিণত হলেন তিনি।

তুমি হতে পার মহান কোনো ফুটবলার। তোমার বাম পা থেকে বেরিয়ে আসে একের পর এক জাদুকরী মুহূর্ত। তুমি হতে পার মহান কোনো গোলদাতা। পরিসংখ্যানে তুমি সেরা হতে পার। কিন্তু পেলে-ম্যারাডোনার মতো কিংবদন্তি! তুমি তা নও। ওদের মতো তোমার হাতে বিশ্বকাপের সোনা রঙা ট্রফি কোথায়! এসব শুনতে শুনতে মেসি তো বটেই, তার ভক্তরাও ছিল মহাবিরক্ত। সব তীর্যক দৃষ্টির জবাবটা দিলেন লিওনেল মেসি। তার হাতে বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি। তিনি কিংবদন্তি। ইতিহাসের সেরা ফুটবলার। আর্জেন্টাইনদের কাছে! তিনি আরেক দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। তার চেয়েও বেশি কিছু কী!

আরব্য রজনীর শেষ গল্পটার নায়ক লিওনেল মেসি। গল্পটা এমন; রাজপুত্রের গুণে মুগ্ধ সবাই। তার ক্ষুরধার মস্তিষ্ক প্রতিপক্ষকে সহজেই হারিয়ে দেয়। কিন্তু রাজপুত্রের ভাগ্যে যেন কোনো রাজকন্যা (বিশ্বকাপ ট্রফি) নেই! অবশেষে দুরন্ত সাহস বুকে নিয়ে ঘুমন্ত পুরীতে গেল রাজপুত্র। সেখানে গিয়ে জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙিয়ে দিল সবার। তারপর? রাজপুত্র বাধার সব পাহাড় জয় করল। পৌঁছে গেল কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। সোনার সিংহাসনে আসীন হলো। রাজপুত্র হয়ে গেল মহাসম্রাট। ফুটবলের মহাসম্রাট। লিওনেল মেসি সেই রাজপুত্র। যার পেছনে পেছনে বিশ্ব জয়ের জন্য বেরিয়েছিল আর্জেন্টিনা। তারা বিশ্ব জয় করল। ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনাকে উপহার দিল বিশ্বকাপের সোনা রঙা ট্রফি। সে ট্রফি জিতে সম্রাটের আসনে বসা লিওনেল মেসি হু হু করে কাঁদলেন। সতীর্থদের কাঁদালেন। তাদের সঙ্গে কাঁদল পুরো লুসাইল স্টেডিয়াম। কাঁদল পুরো আর্জেন্টিনা। কাঁদল সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা মেসির কোটি কোটি ভক্ত।

লিওনেল মেসি যেন অর্কেস্ট্রার কম্পোজার। যার নির্দেশনায় লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে ফুটবলের ছেঁড়া সুরগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা মিলে তৈরি করেছিল অপূর্ব অনুরণন। যে অনুরণন লুসাইল স্টেডিয়ামের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল বিশ্বজুড়ে। কখনো ডি মারিয়া, কখনো আলভারেজ, কখনো ফার্নান্দেজ কখনো ম্যাক অ্যালিস্টার। লিওনেল মেসি খেলিয়ে চলছিলেন পুরো আর্জেন্টিনাকে। নিজে খেলছিলেন অপূর্ব ছন্দ নিয়ে। যে ছন্দ আগে কখনো কেউ দেখেনি। এই বিশেষ রাতটার জন্যই বুঝি লিওনেল মেসি লুকিয়ে রেখেছিলেন বিশেষ কোনো জাদু। বাম পায়ের সেই জাদুতে সম্মোহিত হয়ে পড়ল পুরো ফুটবল দুনিয়া। আর্জেন্টাইনদের মতোই ফরাসি সমর্থকরাও মেসি, মেসি উচ্চরবের সঙ্গে কুর্ণিশ করল। ফুটবলের রাজাধিরাজ তিনি। মহাসম্রাট।

বিশ্বকাপ ট্রফিটা কার? লিওনেল মেসি নাকি কিলিয়ান এমবাপ্পের? নির্ধারিত ৯০ মিনিট খেলার পরও তা নির্ধারণ করা গেল না। মেসি-ডি মারিয়ার দুই গোলে এগিয়ে থাকা আর্জেন্টিনা বিজয় উৎসবের সব প্রস্তুতিই শেষ করেছিল। ম্যাচের বাকি ছিল কেবল ১১ মিনিট। কিন্তু ২ মিনিটের ‘এমবাপ্পের ঝড়’ আর্জেন্টাইনদের স্বপ্ন ভেঙে দেয়। খেলাটা নিয়ে যায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে। সেখানেও নাটক। নাটকের পর নাটক। লিওনেল মেসির গোলে ৩-২ করল আর্জেন্টিনা। এমবাপ্পের পেনাল্টি গোলে ফের ৩-৩ সমতায় ফ্রান্স। নাটকীয় এই ফাইনালের লড়াই গড়াল টাইব্রেকারে। পেনাল্টি শুটে এমবাপ্পে গোল করলেন। মেসিও গোল করলেন। এরপর দুই ফরাসি গোল করতে ব্যর্থ হন। কিংসলের শট ফিরিয়ে দেন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক। অরেলিয়েনের শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। টাইব্রেকারে মেসির পর দিবালা, প্যারেডেস ও মন্টিয়েলের গোল বিশ্বকাপ এনে দেয় আর্জেন্টিনাকে।

দুরু দুরু বুকে দর্শক সারিতে হাজারও মানুষ গুনছিলেন অপেক্ষার প্রহর। তাদের বেশির ভাগের মুখ থেকেই বেরিয়ে আসছিল মদের কড়া গন্ধ। বেশির ভাগই অর্ধ মাতাল হয়েছে মদের বোতল শেষ করে। পুরো মাতাল হলে ফুটবলটা উপভোগ করবে কী করে! তাই অর্ধ মাতাল। ফাইনাল ম্যাচের ¯œায়ুচাপ সহ্য করতে হলে মাতাল হওয়ার প্রয়োজন বৈকি! সে মদ পান করে হোক, কিংবা অন্য কোনো উপায়ে! মদিরা পান করে মাতাল হয়েছেন অনেকে। অনেকে মাতাল হয়েছেন লিওনেল মেসিদের ফুটবল দেখে। ফরাসি ডিফেন্স লাইনে মেসি-ডি মারিয়া-আলভারেজ-ফার্নান্দেজদের আক্রমণগুলো ফুটবল দর্শকদের মাতাল করার জন্য যথেষ্টই ছিল। আর্জেন্টাইন সমর্থকদের বুকের দুরু দুরু ভাবটা কাটিয়ে দিতে বেশি সময় নেননি লিওনেল মেসিরা। ডি মারিয়াকে ডি বক্সের ভিতর ওসমান ডেম্বলে ফাউল করলে পেনাল্টির বাঁশি বাজান পোলিশ রেফারি সাইমন। পেনাল্টি শট থেকে ফরাসি গোলরক্ষক হুগো লরিসকে বোকা বানিয়ে গোল করেন লিওনেল মেসি (২৩ মিনিটে)। এরপর ম্যাক অ্যালিস্টারের পাসে বল পেয়ে ডি বক্সের ভিতর থেকে ডি মারিয়া গোল করেন ৩৬ মিনিটে। কিন্তু আরব্য রজনীর গল্প তখনো শেষ হয়নি। কিলিয়ান এমবাপ্পে ২ মিনিটের ঝড়ে সব এলোমেলো হয়ে গেল। আর্জেন্টিনার সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেল! ৮০ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করার পর ৮১ মিনিটে ডি বক্সের ভিতর থেকে আরও একটি গোল করে মূলত পুরো দৃশ্যপটটাই বদলে দেন এমবাপ্পে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সেই ১০ গোলের মাইলফলক পাড়ি দিলেন তিনি। অতিরিক্ত মিনিটের খেলায় আর্জেন্টিনাকে ফের এগিয়ে দেন লিওনেল মেসি। ভিড়ের মধ্য থেকে গোল করেন তিনি। কিন্তু নাটকটা তখনো বাকি। এমবাপ্পের পেনাল্টি গোলে ফের সমতায় ফ্রান্স। ম্যাচের তখন ১১৮ মিনিট! হ্যাটট্রিক করেও ফ্রান্সকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জেতাতে পারলেন না এমবাপ্পে।

ইউরোপিয়ানরা বলাবলি করছিল, ইউরোপিয়ান ফুটবল যে লেভেলে খেলে ল্যাটিন আমেরিকায় সেই লেভেলটা কোথায়! ল্যাটিনদের খুঁজে পাওয়া যাবে কেবল ইতিহাসের পাতায়। ইতিহাসের পাতা থেকেই যেন উঠে এলেন লিওনেল মেসিরা। দিয়েগো ম্যারাডোনার সেই আর্জেন্টিনার মতোই! ১৯৮৬ সালে যে দলটা বিশ্ব জয় করেছিল। ইউরোপ-আমেরিকার ফুটবল পরাশক্তিগুলো মেনে নিয়েছিল আর্জেন্টিনার বশ্যতা। তিন যুগ পর সেই একই আর্জেন্টিনা।

‘ম্যাজিক ইন দ্য ইয়ার’ গানটা ঠিক মানিয়ে গেল ফাইনালের পর। বাতাসে যে সত্যিই ততক্ষণে ম্যাজিক ছড়াতে শুরু করেছে। যে ম্যাজিকে মুগ্ধ হলো পুরো ফুটবল দুনিয়া। যে ম্যাজিকে লিওনেল মেসি অমরত্ব লাভ করলেন। যে ম্যাজিকে বিশ্বকাপের ট্রফি জয় করল আর্জেন্টিনা। যে ম্যাজিকে ফ্রান্সের ফুটবল ঢেউ থেমে গেল। এমবাপ্পের গতি রুদ্ধ হয়ে গেল। ইউরোপিয়ানদের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। অবশ্য সব ইউরোপিয়ান তো আর এক নয়। লিওনেল মেসিকে নিয়ে সাবেক ইংলিশ ফুটবলার গ্যারি লিনেকার বলেছেন, ‘মেসিকে ছাড়া ফুটবলটা আর কখনই ভালো লাগবে না।’ মেসিকে আকাশি নীল-সাদা জার্সিতে আর কখনই বিশ্বকাপে দেখা যাবে না। ক্লাব ফুটবলেও তো ক্যারিয়ারের শেষ দিকটায় চলে এসেছেন তিনি।

বিশ্বকাপ ফাইনালের গল্পটা এখানেই শেষ। এবার কিছু রেকর্ডের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। লিওনেল মেসি ও ডি মারিয়ার গোল দুটি দারুণ একটা রেকর্ড গড়ল। বিশ্বকাপ ইতিহাসের সব ফাইনাল মিলে ৩৪ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী ফুটবলাররা কেবল দুটি গোল করেছেন (জিদান ২০০৬ সালে এবং লিডহোম ১৯৫৮ সালে)। অথচ এক ফাইনালে মেসি ও ডি মারিয়া (দুজনেরই বয়স ৩৪ বছরের বেশি) গোল করলেন। ফ্রান্সকে গতকাল প্রথমার্ধ্বে গোলমুখি কোনো শটই নিতে দেয়নি আর্জেন্টিনা। ১৯৬৬ সালের পর এমন ঘটনা এবারই প্রথম। এমবাপ্পে ২৩ বছর ৩৬৩ দিন বয়সে বিশ্বকাপে ১০ গোলের রেকর্ড গড়লেন। এর আগে রেকর্ডটা ছিল গার্ড মুলারের (২৪ বছর ২২৬ দিন)।

সর্বশেষ খবর