সোমবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

পরম্পরা

ফরিদুর রেজা সাগর

পরম্পরা

তখন মোহনার বয়স কত? ঠিক মনে নেই। কনা, মেঘনা আর মোহনা মিলে দুবাই ভ্রমণ করে ঢাকায় ফিরছি। সঙ্গে আছেন ছায়ার মতো আমার পরমপ্রিয় মা- প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন। বিশাল প্লেনটা যাত্রা শুরু করতেই অস্বস্তি শুরু হলো। মোহনা তখন একেবারেই শিশু। আমাদের কোলে কোলে থাকে। মুখে ফিডার থাকে। চুকচুক করে দুধ খায়। অনেক সময় খেতেও চায় না। প্লেন রানওয়ে ছেড়ে যেই না আকাশে উড়েছে অমনি শুরু              হলো মোহনার কান্না। একটানা করে কান্নাকাটি। সে কী কান্না। হাত-পা ছুড়ে আকাশ ফাটিয়ে সে কাঁদছে। কনার কোলে থাকবে না। লাফ মেরে বাইরে যেতে চাইছে।

কনা বলল, ওকে নিয়ে একটু হাঁটো।

প্লেনের ভেতরে খুব বেশি হাঁটাচলার জায়গা থাকে না। দুই দিকে সারিবদ্ধ সিট। তার মাঝখানে একজন হাঁটার মতো পরিসর। আমি মোহনাকে আঁকড়ে ধরে করিডোরে হাঁটতে লাগলাম। মোহনার কান্না আরও বেড়ে গেল। দু-একজন বিদেশি যাত্রী উঠে এলেন। মোহনার সঙ্গে দুষ্টুমি করলেন। কোলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই মোহনা ভুলবে না। ওর কান্না আরও বাড়তে লাগল। কনা ছুটে এলো। সন্তানের গালে চুমো খেল।

মা, মা এমন করতে নেই। প্লিজ কান্না থামাও।

কে শোনে কার কথা! তখন সারা শরীর দিয়ে কাঁদছে মোহনা। মাঝে মাঝে জোরে শ্বাস টানছে। একটানা কান্না করা অনেক পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু থামছে না কেন মেয়েটা?

বিমানবালাদের ছোটাছুটি। ওরা চকলেট আনে। একবার গরম পানি আনে। আরেকবার শীতল পানি নিয়ে আসে। কিন্তু মোহনার কান্না থামে না। একজন বিমানবালা ছোট ছোট কয়েকটা ঝুমঝুমি নিয়ে আসে। ঝুমঝুমির শব্দে মোহনা একটু ঝুমঝুমি ধরতে যায়। খুকি খুকি হাত দুটো নড়াচড়া করে। তারপর আবার কান্না শুরু হয়।

আমি কিছুটা বিব্রত। কুণ্ঠিত। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। প্লেনভর্তি যাত্রী। তারা হয়তো চোখ বন্ধ করে শোবেন। কেউ ঘুমাবেন। তাদের আনন্দযাত্রায় আমরা বিঘ্ন সৃষ্টি করেছি। আমার খুব লজ্জা লাগছে। কিন্তু কনা খুব স্বাভাবিক। এসব ও তোয়াক্কা করে  না। ওর মনের ইচ্ছা, প্লেনটাকে ঘুরিয়ে দুবাই এয়ারপোর্টে ফিরে যাক। যাত্রীরা কেন সে ব্যাপারে সাহায্য করছে না? আমি মোহনাকে একবার বুকে নিই। একবার কাঁধে নিই। দু-একজন যাত্রী আমাকে সাহায্য করার জন্য পাশে দাঁড়িয়েছেন। এ সময় আপনা-আপনি মোহনার কান্না থেমে এলো। হয়তো শিশুটি তখন ক্লান্ত। একটু পর ঘুমিয়েও পড়ল মোহনা। আকাশযানটি তখন ঢাকা অভিমুখে তীব্রবেগে ছুটে চলেছে।

দুই

তখন ২০২২ সাল। আমি নিউইয়র্কে অবস্থান করছি চিকিৎসার জন্য। জটিল ব্যাধি। চিকিৎসা পদ্ধতিও জটিল। বেশ কিছুদিন ধরে আমি নিউইয়র্কে। হাসপাতাল আর বাড়ি করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হয়েছি। জীবনটা যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে আছে কনা, মেঘনা-রাফাত। আমার নাতনি মাইরা। কয়েকদিন পর লন্ডন থেকে এলো মোহনা। মোহনা এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে পিএইচডি করেছে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে মোহনা এখন শিক্ষক। বাবার অপারেশন হবে তাই সে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে নিউইয়র্কে। মেয়েরা পাশে থাকলে সব সময় আমি আনন্দিত। কয়েকদিন বাদে মোহনা প্রস্তাব দিল-

চলো বাবা। আমরা লায়ন কিং দেখতে যাই। কোনো একটা থিয়েটার হলে যাব।

অনলাইনে মোহনা টিকিটও কেটে ফেলল। আমাদের হোটেল থেকে থিয়েটার হল খুব বেশি দূরে নয়। দলেবলে এক সন্ধ্যায় আমরা লায়ন কিং দেখতে গেলাম। বিশাল বড় হল। পুরনো স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। বড় বড় খিলান। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হয়। তারপর টিকিটের নাম্বার দেখে সিট খুঁজে নিতে হয়। সিঁড়িতে ওঠার ব্যাপারে মোহনা আমাকে সহযোগিতা করল। মায়ের মতো মোহনা তখন আমাকে ধরে ধরে উঠালো। সিটে বসালো। কিন্তু আমার অস্বস্তি হচ্ছে। কষ্ট করে সিটে বসলাম।

শুরু হলো লায়ন কিংয়ের শো। মঞ্চজুড়ে বিশাল আয়োজন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখছি। ইন্টারভ্যালের সময় টের পেলাম আমার ওয়াশরুমে যাওয়া খুব জরুরি। মোহনা বলল-চলো আমি সাথে যাই।

মায়ের মতো মোহনা আমাকে ধরে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। আমার যদি কোনো ঝামেলা হয় তবে সে সহায়তা করবে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসার পরে মোহনা আমার পাজামা-পাঞ্জাবি ঠিক করে দিল। আমি খুব অসুস্থ। এ কারণে বাড়তি সেবা যত্ন।

আমার মেয়েরা কখন যে ‘মা’ হয়ে গেছে টের পাইনি। ওরাই এখন আমার-মা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর