শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

শুধু দেশের লেখকদের বই নিয়ে মেলা

মারুফ রায়হান

শুধু দেশের লেখকদের বই নিয়ে মেলা

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাসব্যাপী যে বইমেলাটি হয়ে আসছে, কালে কালে সেটি আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছরই মেলা ব্যবস্থাপনার এমন কিছু দিক লক্ষণীয় হয়ে ওঠে, যা আমাদের বিরক্ত-বিব্রত করে। তবু আমরা এই মেলা যেন নির্বিঘ্ন, অবিতর্কিত এবং সর্বাঙ্গীণ সুন্দর হতে পারে, সেটিই চাই। শুধু বাংলাদেশের লেখকদেরই বই নিয়ে (এবং দেশেই মুদ্রিত-প্রকাশিত) একুশের বইমেলাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি পূর্বমীমাংসিত। মেলার যে নীতিমালা   চূড়ান্ত হয়েছে তাতে মেলার প্রকৃতি সম্পর্কে ৭.১ ধারাটিতে পরিষ্কারভাবে বলা আছে- ‘অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশকগণ কেবল বাংলাদেশে মুদ্রিত ও প্রকাশিত বাংলাদেশের লেখকদের মৌলিক/অনূদিত/ সম্পাদিত/সংকলিত বই বিক্রি করতে পারবেন।’ ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো ও একুশের চেতনায় সিক্ত এই বইমেলার প্রকৃতি আগেও বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। এত বছর পরে মনে হচ্ছে এবারও একটি মহল অন্য দেশের বই আমাদের একুশের মেলায় বিক্রির পক্ষে কৌশলে জনমত প্রভাবিত করতে চাইছেন। বলা দরকার, আমাদেরও ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা ছিল, কিন্তু একুশের বইমেলার শতকরা পাঁচ ভাগও সফলতা পায়নি বলে (এ ছাড়াও কিছু কারণ ছিল) সেটির বিলুপ্তি ঘটেছে। এখন দেশের প্রকাশনা শিল্পের চলমানতা, বৈচিত্র্য, বিকাশ ও সমৃদ্ধি- সবকিছুই যেন এই একুশের বইমেলানির্ভর হয়ে উঠেছে। এই একমুখিতা কাটিয়ে বরং বই বিপণন ও প্রসারের জন্য বছরভর দেশজুড়েই ছোট ছোট বইমেলা করা দরকার। যাহোক, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের লেখকদের সঙ্গে আমাদের চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, তাদের বইসহ অন্য অনেক দেশের লেখকদের বইও ঢাকার সব বড় বড় বইয়ের দোকানে একেবারে সামনের সারিতেই প্রদর্শন করা হয়। তবু একুশের বইমেলাতেই কেন বিদেশি বই বিক্রি করতে দিতে হবে?

‘আমাদের বইমেলায় কেন পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশকরা যোগ দিতে পারেন না? কেন বিদেশি লেখকদের বই এই মেলায় ঢুকতে দেওয়া হয় না?’ আপাতনিরীহ এমন সব প্রশ্ন কিছুদিন ধরে উঠতে দেখছি। এটি উত্থাপনের পেছনে রয়েছে একুশের বইমেলার চরিত্র পরিবর্তন কিংবা নীতিমালা বদলে হলেও মেলায় বিদেশি লেখকদের বই বিক্রির সুযোগ পাওয়ার পরিকল্পনা। আমাদের দেশে লেখকের অভাব নেই, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেও আমাদের লেখকরা বাস করছেন। প্রতি বছর নতুন নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেরও জন্ম হচ্ছে, তাদেরকে বইমেলায় স্থানও দিতে হচ্ছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে দেশের বাইরের লেখকদের বই বিক্রির সুযোগ চাওয়ার বিষয়টি শুধু ব্যবসায়িক বিচারে নয়, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দিক বিবেচনায়ও সন্দেহজনক বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। অথচ এ নিয়ে আমাদের বেশির ভাগ লেখকই নীরবতার নীতি গ্রহণ করেছেন, কিংবা হয়তো কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কবি ব্রাত্য রাইসু অবশ্য তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভাষা ও ভঙ্গিতে এর লাগাতার বিরোধিতা করে চলেছেন। তিনি লিখেছেন- ‘আমাদের বইমেলা আমরা নিজেরা নিজেরাই করব, আমরা আমাদের প্রকাশনা শিল্প ও লেখকদের রক্ষা করব, অন্য কাউরে এখানে ঢুকতে দিব না, তাতে আপনাদের কী? আপনাদের ভারতীয় বই দরকার তো বাতিঘরে যান, পাঠক সমাবেশে যান, প্রথমা বা তক্ষশীলায় যান, সেখানে ভারতীয় বইমেলা সারা বছর ধইরা চলতে আছে।’

এ কথাটি শুরুতেই বললে ভালো ছিল যে, চলমান মেলার বেশ কিছু স্টলে আমি দেশের বাইরের লেখকদের লিখিত/অনূদিত/সম্পাদিত বই (এ দেশে মুদ্রিত) রাখতে দেখেছি। এ নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা কাজও শুরু করেছেন। বিষয়টি এমন যে, যেহেতু অন্য দেশের কোনো প্রকাশনা সংস্থাকে একুশের মেলায় স্টল দেওয়ার জোর দাবি তোলা যাচ্ছে না, দেশের বাইরে প্রকাশিত ভিনদেশীয় লেখকদের বই আমদানি করে মেলাতে বিক্রি করার সাহসও কারও হচ্ছে না, তাই এখানেই তাদের বই ছাপিয়ে মেলায় এনে দেখা যাক না কেমন প্রতিক্রিয়া হয়! ঘটনাটি নিন্দনীয়, মেলার নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং নিজের দেশের কল্যাণচিন্তার বাইরে অবস্থান গ্রহণ। নিজ দেশের ভালো সব দেশের মানুষই বোঝেন, শুধু আমাদের মধ্যেই যত সমস্যা- কপটতা, সুবিধাবাদিতা ও হীনমন্যতা।

সর্বশেষ খবর