শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

এক ঢাকায় এত চাপ

উচ্চশিক্ষা, উন্নত চিকিৎসা, উচ্চ আদালত, সরকারি সব বড় অফিস, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সবকিছুই রাজধানীতে ৪৮ বছরে ঢাকার জনসংখ্যা বেড়েছে সাড়ে ছয় গুণ। শুধু উচ্চশিক্ষার জন্যই ঢাকায় থাকছে ২০ লক্ষাধিক মানুষ

শামীম আহমেদ ও হাসান ইমন

জনসংখ্যার চাপে ক্রমেই বেসামাল হয়ে পড়ছে রাজধানী ঢাকা। ঢাকাকে অধিক বাসযোগ্য করতে বারবার বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি সামনে এলেও উচ্চ আদালতে সারা দেশের মামলা, সরকারি-বেসরকারি সব ভালো হাসপাতাল, প্রথম সারির ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠানের হেড অফিস, সব নিয়োগ-বদলি, ভাগ্য বদলে চাকরিপ্রত্যাশীদের ভিড়, নিয়োগ পরীক্ষা, ভর্তি ও চাকরির কোচিং- সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে থামছেই না ঢাকামুখী জনস্রোত। প্রতিদিনই বাড়ছে চাপ। বাড়ছে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, যানজটসহ নানা নাগরিক সমস্যা। ১৯৭৪ সালে প্রথম আদমশুমারিতে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল ১৬ লাখের মতো। ২০২২ সালের সর্বশেষ আদমশুমারিতে সেই জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ জনে। ৪৮ বছরে বেড়েছে সাড়ে ছয় গুণ। এ সময় দেশের সামগ্রিক জনসংখ্যা বেড়েছে দি¦গুণের কিছু বেশি। ৩০৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই মায়াবী রাজধানীতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে গায়ে গা লাগিয়ে বসবাস করছে প্রায় ৩৩ হাজার ৭০১ জন, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে বস্তিতেই বাস করছে ৮ লাখ ৮৪ হাজার মানুষ। ভাসমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও প্রায় সাড়ে ৯ হাজার। জনসংখ্যার ভারে নাকাল দেশের প্রাণকেন্দ্র। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, প্রতি বছর এই শহরের জনসংখ্যায় নতুন করে যোগ হচ্ছে ৬ লক্ষাধিক মানুষ। এ ছাড়া উচ্চ আদালত, হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে প্রতিদিন লাখো মানুষ ঢাকায় ঢুকছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মোটা দাগে পাঁচ-ছয়টি কারণে দ্রুত মানুষ বাড়ছে ঢাকায়। স্বাধীনতার পর একে একে বড় বড় হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা সবই গড়ে উঠেছে এই শহরে। অন্যদিকে শিল্পনগরীর খেতাব হারিয়েছে খুলনার মতো বৈদেশিক বাণিজ্যের সুবিধাজনক স্থান। মামলা-মোকদ্দমার জন্য নীলফামারীর ডোমার বা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার মানুষকেও শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ছুটে আসতে হচ্ছে ঢাকায়। কর্মসংস্থান, গৃহহীনদের আশ্রয়, উন্নত শিক্ষা, ভালো চিকিৎসা- সবকিছুর জন্য মানুষ বেছে নিচ্ছে ঢাকাকেই। রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় গড়ে উঠেছে ঢাকায়। পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ পরীক্ষা হচ্ছে ঢাকায়। প্রতি শুক্রবার সারা দেশ থেকে লাখ লাখ তরুণ-তরুণী চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিতে ছুটে আসছেন রাজধানীতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং করতেও রাজধানীতে মাসের পর মাস পড়ে থাকতে হচ্ছে লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে।

আইনি সেবা পেতে ঢাকায় : ঢাকায় অবস্থিত হাই কোর্টে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজারের মতো মামলার শুনানি হয়। এর মধ্যে বড় একটি অংশ থাকে ঢাকার বাইরে নিম্ন আদালতে হওয়া মামলার প্রেক্ষিতে। কোনো মামলায় আসামি একজন, কোনো মামলায় আবার ১৫-২০ জন। এ প্রক্রিয়ায় অনেককে দুই-তিন সপ্তাহ ঢাকায় অপেক্ষাও করতে হয়। পটুয়াখালীর বাসিন্দা সাইদুর রহমান বাবুল সম্প্রতি নারী নির্যাতন মামলায় জেলা আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হন। পরে তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করেন। এ জন্য তাকে ছুটতে হয় ঢাকায়। বর্তমানে হাই কোর্টে মামলাটি চলমান। হাই কোর্টের আইনজীবী গাজী মোহাম্মদ তৌহিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জেলার আদালতে মামলা শেষ হলে তার প্রায় সবগুলোর গন্তব্যই ঢাকা। সাজা হলে হাই কোর্টে আসতে হয়, আগাম জামিনের জন্য আসতে হয়, মামলা কোয়াসমেন্টের জন্য আসতে হয়। হাই কোর্ট থেকে পরে অ্যাপিলেট ডিভিশনে যায়।

শিক্ষার জন্য ঢাকামুখী মানুষ : সরকারের তথ্য বলছে, পরীক্ষার ফলাফলে নব্বইয়ের দশকেও দেশের সবচেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল জেলা স্কুলগুলো। বর্তমানে সেগুলোর নাজুক অবস্থা। দেশের নামকরা বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন ঢাকায়। সংখ্যায়ও বেশি। মফস্বলের একটি স্কুল বা কলেজ যেখানে শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে, ঢাকায় তখন ভর্তি নিয়ে চলছে অভিভাবকদের যুদ্ধ। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস)সহ বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, শুধু উচ্চশিক্ষাকে কেন্দ্র করে এই শহরে বসবাস করছে ২০ লক্ষাধিক মানুষ। এ ছাড়া সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়াম বা নামকরা বড় স্কুলে পড়াতেও অনেক পরিবার হয়েছেন ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। ১৪২টি নিবন্ধিত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ৭৬টিরই অবস্থান ঢাকায়। ফলাফলের ভিত্তিতে দেশের শীর্ষ ১০ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলও এই শহরে। অর্ধশতাধিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক-পঞ্চমাংশ ও শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেকই ঢাকায়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে ও সন্তানকে পড়াতে ঢাকার বাসিন্দা হচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। একই সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন নামকরা কলেজ, মেডিকেল কলেজ, আইন কলেজ, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নার্সিং ইনস্টিটিউট ও প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শিক্ষা নিতে ঢাকার বাইরে থেকে ছুটে আসছেন শিক্ষার্থীরা। অসংখ্য কোচিং সেন্টারে চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতেও ঢাকায় পাড়ি জমাচ্ছে লাখো মানুষ। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীও এখন ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা।

উন্নত চিকিৎসায় ভরসা ঢাকা : হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, অর্থোপেডিক, শিশু, ক্যান্সার, বক্ষব্যাধিসহ সব জটিল রোগের বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে উঠেছে ঢাকায়। এসব হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য সারা দেশ থেকে ঢাকায় ছুটছে মানুষ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন সাড়ে ৪ হাজারের বেশি রোগী দেখা হয়, যার বড় অংশ আসছে ঢাকার বাইরে থেকে। অন্য জেলা ও বিভাগীয় হাসপাতাল থেকেও রোগী পাঠানো হচ্ছে ঢাকায়। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য বলছে, দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৪টি ও ৭২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৩১টিই ঢাকা শহরে। এ ছাড়া ১৮টি সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের মধ্যে ১৪টিই ঢাকায়। রোগীর পাশাপাশি সারা দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসছেন এসব মেডিকেল কলেজে। একই সঙ্গে পাঁচতারকা মানের সব বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে ঢাকায়। ফলে চিকিৎসা ও হাসপাতালকেন্দ্রিক ব্যবসা ও কর্মসংস্থানের জন্য লাখ লাখ মানুষ ঢুকছে ঢাকায়।

কর্মসংস্থান : ঢাকায় জনস্রোতের অন্যতম কারণ কর্মসংস্থান। সবজি বিক্রি, রিকশা চালনা, নির্মাণ শ্রমিক বা গৃহকর্মী, ঢাকায় এলেই মিলবে কাজ- এমন ধারণা থেকে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর (বিবিএস) জরিপে ২০১৮ সালে দেশে মোট ৯ লাখ ৪৯ হাজার ৫৯০টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট ছিল, যার ২ লাখ ৬১ হাজার ৭০৫টিই ঢাকায়। সংস্থাটির হিসাবে শিল্প কর্মসংস্থানের ৪৫ শতাংশই ঢাকায়। এ ছাড়া অনেক মানুষ ঢাকায় এসে রিকশা চালনা, নির্মাণশ্রমিক, গৃহকর্মীসহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যুক্ত হচ্ছেন। গত এক দশকে নদীভাঙনে ৬৮ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে, যার একটি বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছে রাজধানীতে।

ঢাকাতেই সব নিয়োগ পরীক্ষা : গতকাল ২৪ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের কার্য-সহকারী পদে পরীক্ষা দিতে সারা দেশ থেকে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী ছুটে আসে ঢাকায়। পরীক্ষার্থী স্ত্রীকে ইডেন মহিলা কলেজে পরীক্ষার জন্য ঢুকিয়ে দিয়ে রাস্তার পাশে ১১ মাসের বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বামী তৈয়বুর রহমান। সকালেই যশোর থেকে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় এসে নেমেছেন বলে জানান তিনি। এই কেন্দ্রের সাড়ে ৭ হাজার পরীক্ষার্থীর বড় অংশই এসেছিলেন ঢাকার বাইরে থেকে। সব সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়। এ জন্য প্রতি শুক্রবার সকাল-বিকাল ব্যস্ত থাকে ঢাকার বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। হাজার হাজার পরীক্ষার্থী ছুটে আসেন ঢাকার বাইরে থেকে, সঙ্গে থাকেন অভিভাবক।

ঢাকাতেই সব প্রধান কার্যালয় : ঢাকায় বনভূমি না থাকলেও সারা দেশের বনজঙ্গল দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা বনবিভাগের প্রধান কার্যালয় ঢাকায়। সেচ ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে ঢাকার সংসদ ভবন এলাকায়। অল্প কিছু ছাদকৃষি ছাড়া ঢাকায় তেমন কোনো আবাদ না থাকলেও ফার্মগেটের বড় অংশজুড়ে অবস্থিত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। হাওর না থাকলেও পান্থপথ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড। পান্থপথ মোড়ে তৈরি করা হয়েছে বিশালাকার পানি ভবন। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও প্রতিদিন এখানে সেবা নিতে ঢাকার বাইরে থেকে আসছে অসংখ্য মানুষ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ বাড়াচ্ছে যানজট, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণসহ নানা নাগরিক সমস্যা। ভয়াবহ বায়ুদূষণের কারণে এই শহরের মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে সাত বছর। বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ শব্দদূষণের শিকার ঢাকার বাসিন্দারা। গণপরিবহন সংকট ও ভয়াবহ যানজটে নাভিশ্বাস নাগরিকদের। শেষ হয়ে যাচ্ছে শিশুদের খেলার জায়গা। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা। মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ জীবন। নেই হাঁটার উপযোগী ফুটপাতও। দূষণ ও অস্বাস্থ্যকর জীবনের কারণে ডাক্তার হয়েছে নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী। সেই সঙ্গে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর