সময়ের হিসাব-নিকাশের সুবিধার জন্য বহু আগে থেকেই মানুষ বছরকে ১২ মাসে ভাগ করে নিয়েছে। এর মধ্যে রমজানও একটি মাস ছিল। প্রচুর গরম পড়ত বলে এ মাসের নাম রমজান বা গরমের মাস হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। তীব্র শীত সহ্য হলেও তীব্র গরম সহ্য হওয়ার মতো নয়। বিশেষ করে মরু আরবের মানুষের কাছে। কিন্তু আল্লাহর কী লীলা! এ অসহ্য অপছন্দনীয় গরমের মাসেই বিশ্ব মানবতার মুক্তির সংবিধান আল কোরআন নাজিল করলেন তিনি। কেয়ামত পর্যন্ত মুমিন-মুসলমানদের কাছে চরম ও পরম কাক্সিক্ষত মাস হিসেবে আদরণীয় হয়ে গেল মাহে রমজান।
কোরআন নাজিলের মাস হওয়ায় এ মাসে চারদিকে কোরআন চর্চার জোয়ার দেখা যায়। মসজিদে মসজিদে খতম তারাবি, ঘরে ঘরে কোরআন খতম পড়া, বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার উদ্যোগে কোরআন শিক্ষার আসর ইত্যাদি আয়োজনে পুরো মাসটা কোরআনময় হয়ে থাকে। আসলে পৃথিবীতে যতগুলো দামি কাজ আছে তার মধ্যে প্রথম কাজটিই হলো কোরআন তেলাওয়াত করা। জলিলে কদর সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বিষয়টি খুব পরিষ্কারভাবে বলেছেন নবীজি (সা.)। হাদিসটি হলো-
রসুল (সা.) বলেন, ‘দুই ব্যক্তি ছাড়া কেউ হিংসা করার মতো নয়। এক. যে ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা কোরআনের জ্ঞান দান করেছেন এবং দিন-রাত কোরআন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দুই. যে ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা ধনসম্পদ দান করেছেন এবং সে রাত-দিন তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)।প্রথম ব্যক্তির ব্যাপারে হাদিসের ভাষাটা দেখুন-‘রাজুলুন আতাহুল্লাহুল কোরআনা ফাহুয়া ইয়াকুমু বিহি আনা আল্লায়লি ওয়া আনা আন্নাহার।’ লক্ষ্য করুন! এখানে ‘ইয়াকুমু’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ যাকে কোরআন দান করেছেন এবং সে দিনে ও রাতে কোরআন কায়েম করে। অনুবাদে আমরা লিখেছে, দিনে ও রাতে সে কোরআন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আসলে হাদিসটির তাৎপর্য অনেক গভীর। সহজ কথায় দিনে ও রাতে বলে দিন রাত ২৪ ঘণ্টা তথা প্রতিটি সিঙ্গেল মুহূর্তই বুঝানো হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় সে কোরআন কায়েম করবে। কায়েম শব্দে অনেক রকম অর্থ হয়। একটি অর্থ হলো- কোরআন অনুযায়ী চলা। নিজে কোরআন মানার সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও যেন কোরআন মানে সে দাওয়াতে ব্যস্ত থাকা। কোরআনের শিক্ষা ও প্রচার করেই ক্ষান্ত হবে না বরং সে অন্যকেও কোরআন শেখানোর মিশন নিয়ে মাঠে নামবে। এ ছাড়া দিনে ও রাতে নামাজ কিংবা নামাজের বাইরে কোরআন তেলাওয়াত করবে, কোরআন বুঝবে এবং কোরআন নিয়ে গবেষণা করবে। এসব বিষয় নবীজি (সা.) মাত্র একটি শব্দ ‘ইয়াকুমু’ দিয়ে প্রকাশ করেছেন।
আরবি হাসাদ শব্দের বাংলা অর্থ হিংসা ও ঈর্ষা। ইসলামে অন্যকে হিংসা করা স্পষ্ট হারাম। বরং হিংসার আগুনে পুড়ে ব্যক্তির নেক আমল মুহূর্তেই ছাই হয়ে যায় বলে হাদিস শরিফে সাবধান করা হয়েছে। কিন্তু এ হাদিসে বলা হয়েছে, ‘লা হাসাদা ইল্লা আলাছনাইনে’ অর্থাৎ দুই ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও জন্য হিংসা করা জায়েজ নেই। হিংসা কাকে বলে? হিংসা হলো অন্য ব্যক্তির যা আছে তা দেখে নিজের মনে তা পেতে ইচ্ছা করা। শুধু এতটুকুই হিংসার পরিপূর্ণ সংজ্ঞা নয়। বরং ওই ব্যক্তির ভালো জিনিসটি না পাওয়া পর্যন্ত মনে এক ধরনের আগুন জ্বলতে থাকে। এটাই হিংসা। এ কারণে বলা হয়, হিংসুক কখনো সুখী হয় এবং হিংসুকের কারণে যাকে হিংসা করা হচ্ছে তার সুখ-শান্তিরও কমতি হয় না। যাই হোক, নবীজি বলতে চাচ্ছেন, তোমরা দুনিয়ার সম্পদের জন্য হিংসা কর না। বরং আখেরাতের সম্পদের জন্য হিংসা কর। মনে মনে আফসোস অনুভব কর, হায়! ওই ব্যক্তিকে আল্লাহ কোরআনের সম্পদ দান করেছেন, আমাকেও কেন দিচ্ছেন না। আসলে কোনো মানুষ যখন এভাবে আফসোস করবে তখন তার মনোজগতে যে গভীর মূল্যবোধ সৃষ্টি হবে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। একটি বাস্তব উদাহরণ দিই। এক লোক মসজিদে নামাজের জন্য দাঁড়িয়েছে। সামনের কাতারে জায়গা ফাঁকা। তিনি অন্য একজনকে ঠেলে সামনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আরেকজন লোক পেছন থেকে দৌড়ে এসে প্রথম কাতারে জায়গা করে নিল। এ দুই ব্যক্তির মনোজগৎ কি একইরকম মূল্যবোধে গড়া? একজন ভাবছে কোনোরকম নামাজ শেষ করলেই হলো, অন্যজন ভাবছে নামাজ তো পড়বই- সামনের কাতারের ফজিলত যেন মিস না হয়। তো নবীজি এটাই বুঝাতে চাচ্ছেন, হিংসা করা তো জায়েজ নেই। যদি করতেই হয়, তাহলে আখেরাতের বিষয়ে হিংসা কর। অন্যের মতো নিজেও ইবাদত গোজার মানুষ হওয়ার চেষ্টা কর। তাই আসুন! আজ থেকে রমজানের বাকি দিনগুলো কোরআন কায়েমে নিজেকে ব্যস্ত রাখি। আল্লাহ আমাদের সহি বুঝ দিন। আমিন।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর,
www.selimazadi.com